সিয়াম সাধনার মাস রমজানুল মোবারকের অষ্টম দিবস। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বাস ও তার বিধানের কাছে মাথা নত করে দেয়ার মানসিকতা প্রমাণের মাধ্যমে এই মাস মূলত পাপাচার থেকে মুসলমানদের দূরে রাখার মাস। এ মাস জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার সনদ অর্জনের মাস। তাই সব জেনেও যেসব ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যে ভেজাল মিশ্রণ করে এবং তা মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দেয় ওইসব মজুদদের চেয়ে আর হতভাগা কেউ নেই। তাদের জন্য নিশ্চিত জাহান্নাম। আল হাদিস।
এছাড়া পণ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ক্রেতাকে পরিমাপে কম দেয়া কিংবা মেপে নেয়ার সময় বেশি নেয়াকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। কোরান-হাদিসে এ ধরনের অপতৎপরতাকে অত্যন্ত নিন্দনীয় ও পরকালীন দুর্ভোগের কারণ বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় নেয়। আর যখন লোকদের মেপে দেয়, তখন কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে? সেই মহা দিবসে। যেদিন মানুষ দন্ডাায়মান হবে বিশ্বপালকের সম্মুখে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১-৬)।
তিনি আরো বলেন, ‘তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদ- (দাঁড়িপাল্লা)। যাতে তোমরা সীমালংঘন না কর তুলাদন্ডে। তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম কর এবং ওজনে কম দিও না’ (রহমান ৫৫/৭-৯)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে। আমরা কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দেই না’ (আন'আম ৫/১৫২)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো কওম চুক্তিভঙ্গ করলে আল্লাহ তাদের ওপর তাদের শত্রুকে বিজয়ী করে দেন কেউ আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানের বাইরে ফায়সালা দিলে তাদের মধ্যে দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়ে। কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে অশ্লীল কাজ বিস্তৃত হলে তাদের মধ্যে মৃত্যু অর্থাৎ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। কেউ মাপে বা ওজনে কম দিলে তাদের জন্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে। কেউ জাকাত দেয়া বন্ধ করলে তাদের থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেয়া হয়’।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা.) যখন বাজারে যেতেন, তখন বিক্রেতাদের উদ্দেশে বলতেন, ‘আল্লাহকে ভয় কর। মাপ ও ওজন ন্যায্যভাবে কর। কেননা মাপে কম দানকারীরা কিয়ামতের দিন দন্ডায়মান থাকবে এমন অবস্থায় যে, ঘামে তাদের কানের অর্ধেক পর্যন্ত ডুবে যাবে।’
কোনো পণ্যে ভেজাল মিশ্রণকেও অত্যন্ত গর্হিত কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া যেসব পণ্যে বিভিন্ন কারণে দোষ-ক্রটি থাকে সেগুলো গোপন রেখে বা কৌশলে তা বিক্রি করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হচ্ছে ক্রেতাকে উক্ত দোষ-ক্রটি সম্পর্কে জানাতে হবে। বিক্রয়ের সময় পণ্যের দোষ-ক্রটি বলে দেয়া না হলে তা হালাল হবে না।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়, ততক্ষণ তাদের চুক্তি ভঙ্গ করার এখতিয়ার থাকবে। যদি তারা উভয়েই সততা অবলম্বন করে এবং পণ্যের দোষ-ক্রটি প্রকাশ করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি তারা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে এবং পণ্যের দোষ গোপন করে, তাহলে তাদের এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত দূর হয়ে যাবে।’
এদিকে মজুদদারিদের হুশিয়ার করে দিয়ে মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে, সে পাপিষ্ঠ'। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘অপরাধী (পাপিষ্ঠ) ব্যক্তি ছাড়া কেউ মজুদদারি করে না।’
ক্রয়-বিক্রয়ে মিথ্যা কসমকে অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, 'কসম খাওয়ায় মালের কাটতি বাড়ায়, কিন্তু বরকত কমে যায়'।
মিথ্যা কসমকারী ব্যবসায়ীর প্রতি কঠোর হুশিয়ারি প্রদান পূর্বক রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দৃষ্টি দেবেন না এবং তাদের পবিত্রও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আবু যার (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! কারা ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত? জবাবে তিনি বলেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোটা প্রদানকারী এবং ওই ব্যবসায়ী যে মিথ্যা কসম করে তার পণ্য বিক্রি করে'।
ভেজালমিশ্রিত স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য বিক্রেতাদের হুশিয়ার করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না এবং কারো ক্ষতি কর না'। তিনি ইরশাদ করেন, 'এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কিছুই নেই যে, তুমি এমন ব্যক্তির সঙ্গে মিথ্যার আশ্রয় নেবে যে তোমাকে বিশ্বাস করে।' অন্য এক হাদিসে এসেছে, 'যে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ দুটি হাদিসের আলোকেই প্রমাণিত হয়, ভেজাল ব্যবসায়ী ইসলামী আদর্শের গণ্ডি বহির্ভূত গণ্য হবে।
ভেজাল মিশ্রণকারীকে জুলুমবাজ আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে, কোনো বিক্রেতার যদি তার ব্যবসায় ভেজাল মিশ্রণের প্রবণতা থাকে তাহলে সে পণ্যের মূল্য সাশ্রয় না করে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যের ন্যায় তার মূল্য নির্ধারণ করে। এতে ক্রেতারা এক প্রকার জুলুমের শিকার হন। এছাড়া এ ধরনের লেনদেনে শঠতা, প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির সম্ভাবনা থাকে। ফলে এটি অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণের এক অপকৌশল। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, 'হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করিও না।'
পণ্যদ্রব্যের ভেজাল প্রবণতার ফলে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য অস্বাস্থ্যকর ও বিভিন্ন রোগের নিয়ামক শক্তিরূপে পরিণত হওয়ার ফলে এর বিষাক্ত ছোবলে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। পবিত্র কোরান এ ধরনের গুপ্ত হত্যাকে সর্বাধিক জঘন্যতম অন্যায় ও অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইরশাদ হয়েছে, 'এ কারণেই বনি ইসরাইলের প্রতি এ বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কর্ম করা, হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকে হত্যা করল।'
কোনো পণ্য ক্রয় করার পর নিজ আয়ত্তে আসার পূর্বে বিক্রি করতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, 'যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য ক্রয় করেছে সে যেন তা গ্রহণ ও তার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পূর্বে বিক্রয় না করে'।
এদিকে এক মুসলিমের দর-দামের ওপর অপর মুসলমানকে দর-দাম করতে নিষেধ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোন ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের দর-দামের ওপরে দর-দাম করবে না।’
এছাড়া অনুমানের ওপর নির্ভর করে ক্রয়-বিক্রয় করলে ক্রেতা বা বিক্রেতা যে কোনো একজন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এ আশঙ্কায় রাসুলুল্লাহ (সা.) অনুমানভিত্তিক বা স্তূপ আকারে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। জাবির ইবনে আবদুুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) খেজুর মাপার জন্য প্রচলিত পরিমাপক দ্বারা না মেপে স্তূপ আকারে খেজুর বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :