ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণ লেনদেন বৈধ। তবে ঋণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সাহায্য করা, তাদের প্রতি দয়া করা তথা তাদের জীবনযাপনে সহযোগিতা করা, সহযোগিতার আড়ালে সুবিধা অর্জন নয়। তাই বলা হয়েছে, ঋণের উদ্দেশ্য হবে আধ্যাত্মিক বৃদ্ধি বাহ্যিক বৃদ্ধি নয়। আর তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এই কারণে ঋণগ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় যা নিয়েছে তা কিংবা সেই অনুরূপ ফেরত দিতে।
আদিষ্ট, অতিরিক্ত নয়। ঋণ দাতা এর অতিরিক্ত নিলে কিংবা ঋণগ্রহীতা অতিরিক্ত ফেরত দিলে, তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। কারণ ফিকহী মূলনীতিতে উল্লেখ হয়েছে, ‘কুল্লু কার্জিন র্জারা নাফআন ফাহুআ রিবা।’ অর্থাৎ প্রত্যেক ঋণ, যার মাধ্যমে লাভ উপার্জিত হয়, তা সুদ।
নবী (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দুনিয়াবী বিপদ দূর করবে, আল্লাহতায়ালা তার আখিরাতের বিপদ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর কষ্ট সহজ করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতে সহজ করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্য করেন যতক্ষণে বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে।’ [মুসলিম, অধ্যায় : জিকর, দুআ, তাওবাহ ও ইস্তিগফার]’
নবী (সা.) আরো বলেন, 'যে কেউ কোনো মুসলিমকে দুইবার ঋণ দেয়, তা সেই অনুযায়ী একবার সাদাকা করার মতো।' [ইবনু মাজাহ, সূত্র হাসান, ইরওয়াউল গালীল নং১৩৮৯]
ঋণ লেনদেনে মেয়াদ নির্ধারণ জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, 'হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধারে কারবার করবে, তখন তা লিখে রাখবে।' [সূরা বাকারাহ - ২৮২]
অতঃপর মেয়াদ নির্ধারিত থাকলে ঋণদাতা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে ঋণ ফেরত নেয়ার দাবি করতে পারে না। বরং সে নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধ্য। কারণ নবী (সা.) বলেন, 'মুসলিমগণ শর্ত পূরণে বদ্ধপরিকর।' [আহমদ,আবু দাউদ, তিরমিযী]
এদিকে ইসলাম ঋণ দেয়াকে যেমন লোকের সাহায্য তথা তাদের কষ্ট দূরীকরণ হিসেবে স্বীকার করে, তেমন ঋণ পরিশোধে উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করে। তাই ঋণগ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় বেশি বা উত্তম ফেরত দিতে পারে, যাকে শরীয়তের পরিভাষায় 'হুসনুল কার্জা' বা উত্তম পরিশোধ বলে।
ইবনুল মুনজির বলেন, 'তাদের ঐকমত্য রয়েছে যে, ঋণদাতা যদি ঋণগ্রহীতাকে ঋণ ফেরতের সময় বেশি দেয়া কিংবা হাদিয়াসহ ঋণ ফেরত দেয়ার শর্ত দেয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ দেয়া হয়, তাহলে বেশি নেয়াটা সুদ।' [মুগনি,৬/৪৩৬] তাই ঋণ ফেরতের সময় বেশি গ্রহণ বৈধ নয়, যতক্ষণে দুটি শর্ত না পাওয়া যায়।
১. ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার সঙ্গে লাভ নেয়ার শর্ত দেয়নি। ২. সমাজে বেশি দেয়ার প্রথা প্রচলিতও নয়। যদি শর্ত দেয়া হয় কিংবা এটা সমাজে প্রচলিত থাকে, তাহলে বেশি নেয়া সুদ হবে। এদিকে ঋণদাতা যখন মানুষের উপকার্থে ঋণ প্রদান করে, তখন ঋণগ্রহীতার দ্বীনি ও নৈতিক দায়িত্ব হবে তা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তা ফিরিয়ে দেয়া। মহান আল্লাহ বলেন, ‘উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?' [সূরা আর রাহমান-৬০] তিনি অন্যত্রে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, হকদারদের হক তাদের নিকট পৌঁছে দিতে।' [সূরা নিসা-৫৮]
নবী (সা.) বলেন, ‘ধনী ব্যক্তির টাল-বাহানা করা অত্যাচার।’ [মুত্তাফাকুন আলাইহ] তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমতাবস্থায় যে, সে তিনটি স্বভাব থেকে মুক্ত ছিল, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবেথ অহংকার, গনীমতের সম্পদ হতে চুরি এবং ঋণ।' [ইবনু মাজাহ, আলবানী (রহঃ) সহিহ বলেছেন]
তবে সত্যিকার অর্থে যে ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম, তাকে ইসলাম অতিরিক্ত সময় দিতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'যদি ঋণী দরিদ্র হয়, তবে সচ্ছল অবস্থা আসা পর্যন্ত অবকাশ দিবে আর মাফ করে দেয়া তোমাদের পক্ষে অতি উত্তম, যদি তোমরা জানতে!' [সূরা বাকারাহ- ২৮০]
নবী (সাঃ) বলেন, 'যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি দিবে, সে যেন অভাবী ঋণীকে অবকাশ দেয় কিংবা তার ঋণের বোঝা লাঘব করে।' তবে ঋণগ্রহীতা যদি নির্ধারিত সময়ে ঋণ ফেরত দিতে না পারে, তাহলে তাকে অবকাশ দিতে হবে বিনা লাভের শর্তে। কিন্তু যদি ঋণ দাতা তার মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় এবং এর বিনিময়ে লাভ নেয় তাহলে তা স্পষ্ট সুদ হবে।
এদিকে কেউ কাউকে ঋণ দিলে এবং সেই ঋণ জাকাতের আওতায় পড়লে, ঋণ দাতাকেই সেই মালের জাকাত দিতে হবে। তবে ইসলামী গবেষকরা বলেন, ঋণগ্রহীতা যদি অভাবী হয়, যার কারণে সে সঠিক সময় ঋণ ফেরত দিতে অক্ষম কিংবা সক্ষম তবে টাল-বাহানাকারী, যার থেকে ঋণ আদায় করা কষ্টকর। এই ক্ষেত্রে ঋণ দাতার প্রতি সেই মালের জাকাত দেয়া জরুরি নয়, যতক্ষণে তা তার হাতে না আসে। আর যদি ঋণী ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে সক্ষম হয় তথা সেই ঋণ পাওয়ার পুরো সম্ভাবনা থাকে, তাহলে জাকাতের সময় হলেই ঋণ দাতাকে তার জাকাত আদায় করতে হবে।
হাদিসে এসেছে, নবী (সা.) ঋণ হতে আল্লাহর নিকট বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, যা দেখে এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, আল্লাহর রাসূল! আপনি ঋণ থেকে কেন খুব বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করেন? নবী (সা.) বলেন, 'মানুষ ঋণী হলে, যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে এবং অঙ্গীকার করলে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে।' [বুখারি, অধ্যায় : ইস্তিকরাজ, নং ২৩৯৭]
আপনার মতামত লিখুন :