নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে চলেছেন চন্দন শীল যিনি ২০০১ সালের ১৬ জুন চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে নৃশংস বোমা হামলা দুটি পা হারিয়েছেন। সেই বর্বরোচিত ঘটনার পর থেকে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা স্বার্থের রাজনীতিতে এগিয়ে গেলেও প্রতি বছর কৃত্রিম পায়ে স্ক্র্যাচে ভর করেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতির পদে থাকা চন্দন শীল। ঝড় বৃষ্টি রোদ উপেক্ষা করে প্রতি বছরের ১৬ জুন সকালেই চাষাঢ়ায় দেখা মিলে তাকে। শুরুতে আওয়ামী লীগের জেলা ও মহানগরের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি নিহত পরিবারের প্রায় সকলে আসলেও ধীরে ধীরে লোকজনের উপস্থিতিও কমতে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে নেতাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তবে নিয়মিতই দেখা মিলছে চন্দন শীলের। বিচার না পাওয়ার সঙ্গে পরিবারের অসহায়ত্বে নোনা জ্বলে ভেসে যায় বুকের বেদনা।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সাল হতে ২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি ছিলেন শামীম ওসমান। তখন শহরের চাষাঢ়ায় শহীদ মিনারের দক্ষিণ পশ্চিম কোনে ছিল আওয়ামী লীগের একটি অফিস যেখানে সপ্তাহের প্রতি শনিবার ও সোমবার সাধারণ মানুষের জন্য সাক্ষাৎ করতেন তিনি। ২০০১ সালের ১৬ জুন ছিল সোমবার। সেদিন বিকেলের পর থেকেই অফিসে জড়ো হতে থাকেন লোকজন। সকলের উদ্দেশ্যে ছিল শামীম ওসমানের সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু তখনো কেউ বুঝতে পারেনি সামনে অপেক্ষা করছে যমদূত। রাতে যখন একে একে শামীম ওসমান লোকজনদের সাক্ষাৎ দিচ্ছিলেন তখনই ঘটে বিস্ফোরণ। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী আডিএস গ্রেনেড বিস্ফোরণে লন্ডভন্ড হয়ে যায় অফিসটি।
নিহত হয়েছিল শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী, সহোদর সরকারী তোলারাম কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদের জিএস আকতার হোসেন ও সঙ্গীত শিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সঙ্গীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক এ বি এম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামীলীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েতউল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী, স্বপন রায় ও অজ্ঞাত এক মহিলা। নিহত মহিলার পরিচয় পেতে তেমন কোন চেষ্টা করেনি প্রশাসন। হামলায় শামীম ওসমান সহ অর্ধশতাধিক আহত হয়। তার ব্যক্তিগত সচিব চন্দন শীল, যুবলীগ কর্মী রতন দাস দুই পা হারিয়ে চিরতরে বরণ করেছে পঙ্গুত্ব।
নৃশংস বোমা হামলা নিহত ২০টি পরিবারের স্বজনদের কান্না আজো থামেনি। একে একে ২১ বছর চলে গেল। মিডিয়ার কল্যাণে এখনকার প্রজন্ম জানেন ২১ বছর আগে চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলায় মারা গেছে ২০ জন। চাষাঢ়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পশ্চিম দক্ষিণ কোণে সেই অফিসের স্থলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ থাকলেও অনেকেই এটা নিয়ে আর মাথায় ঘামায় না। বোমা হামলায় নিহত পরিবারগুলোর বেশীরভাগই ভালো নেই। অভাব অনটন লেগেই আছে। চরম কষ্টে দিনাতিপাত করলেও খবর নেওয়া হয় না নেতাদের পক্ষে। ১৬জুন আসলে কারো কারো বাসায় খবর পাঠানো হয়। এছাড়া বাকি দিন তাদের কেউ খবর নেয় না। এভাবেই ২১ বছর কেটে গেলেও বিচার হয়নি। আর এর পেছনে ‘রাজনীতি’ দেখছেন নিহতের পরিবার ও স্বজনেরা। তারা বলছেন কেউ আন্তরিক না বিচার করতে। আন্তরিক হলে এতদিনে বিচার হয়ে যেত। সম্প্রতি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিনেও হাজির হননি অনেকেই। ফলে বিচারের ভবিষ্যৎ নিয়েও আছে প্রশ্ন শঙ্কা।
নিহতের স্বজনদের অভিযোগ ২০ জনের প্রাণহানি, কারো অঙ্গহানি সহ অর্ধশত আহতের ঘটনার পরেও ২১ বছরে শুধু রাজনীতি হয়েছে। কখনো বিএনপি কখনো আওয়ামী লীগ। পাল্টাপাল্টি মামলা নিয়ে তদন্ত করেই সময় পার। ২০০১ সালের পর ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিল বিএনপি। পরের ২ বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ৭ বছর ছাড়া ২১ বছরের মধ্যে ১৪ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়।
জানা যায়, ২০০১ সালে গ্রেনেড হামলায় আহত হবার পরেই দেশ ছাড়েন শামীম ওসমান। বিএনপি জামায়াতের হাতে ক্ষমতাকালে আওয়ামীলীগের অবস্থা যখন ক্রান্তিলগ্নে তখন ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারী তৎ সময়ের পৌরসভা নির্বাচনের মাত্র ১৬ দিন আগে নিউজিল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেন সেলিনা হায়াৎ আইভি। দলের নেতৃবৃন্দের অনুরোধে বিএনপি ক্ষমতাকালীন বিএনপির প্রার্থীকে নির্বাচন করে পরাজিত করে চেয়ারম্যান হন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার। এর পর কেয়ারটেকার সরকারের সময়ে কোন পক্ষই দেশে সুবিধা করতে না পারলেও নিজের দলের নেতাকর্মীদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করতে সক্ষম হন আইভী।
এছাড়া ১৬ জুন নিহত দেলোয়ার হোসেন ভাষানীর ছোট ভাইকে নাসিকে চাকরি, সাইদুর রহমান মোল্লা সবুজের ভাগ্নেকে নাসিকে চাকরি, তোলারাম কলেজের তৎকালীন জিএস আক্তার হোসেনের স্ত্রীকে ফ্ল্যাট প্রদান, মোশাররফ হোসেন মশুর স্ত্রীকে দোকান প্রদান সহ আরও অনেককে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করেন মেয়র আইভী। এছাড়া সাইদুল হাসান বাপ্পীর নামে শহরে বাপ্পী স্মরণী সড়কের নামকরন ও করে তাদেরকে অমর করে রেখেছেন তিনি।
এসকল বিষয় নিয়ে মেয়রের সমর্থক ও সহায়তা পাওয়া পরিবারের সদস্যরা বলেন, শামীম ওসমান ও তার সমর্থকরো ১৬জুন নিহতদের নিয়ে কেবল রাজনীতি আর গলাবাজি করতে জানেন। তারা কি সহায়তা করেছেন নিহতদের জন্য তা জানতে চাই। মেয়র আইভি সাহায্য সহযোগীতা করে গলাবাজি কিংবা প্রচার করে বেড়াননি। অথচ শামীম ওসমান ও তার সমর্থকরা কিছু না করেই উল্টো বড় বড় বুলি আউড়ে যাচ্ছেন। এসকল বিষয়ে বলার আগে তৎকালীন সময়ে তাদের নিজেদের অবস্থানও জনসম্মুখে আনা উচিৎ।
গণমাধ্যমে গত কয়েক বছরে কবি মোক্তার হোসেনের পরিবার থেকে জানানো হয়, ২নং বাবুরাইলের মরহুম আবু হানিফ ও মতিয়া বেগমের বড় ছেলে কবি মোক্তার হোসেন তিনি দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন বড় ছেলে সাইদ হাসান ইমন ও ছোট ছেলে মতিউর রহমান লিংকন, একমাত্র কন্যা সায়েকা আহমেদ। পরিবারটি নিদারুন আর্থিক অনটনে ভুগছেন। ঐ সময় অনেক বড় বড় নেতা আশ্বাস দিলেও তার কোনো প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই নাই। বর্তমানে বেগম মোক্তারের পরিবার দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে চলেছেন।
দেলোয়ার হোসেন ভাসানীর দুই ছেলে ইফতেখার হোসেন আদর ও আরান এর আগে জানান তাদের কষ্টের দিনের কথা। তারা জানায়, বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাই। আমরা বোমা হামলাকারীদের ফাঁসি চাই। বাবার রেখে যাওয়া একজন ব্যবসায়ীর কাছে ৫ লাখ টাকা। সেই টাকা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ হিসেবে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা পাই। আর নানা বাড়ি থেকে সহযোগীতা নিয়েই সংসার ও তাদের লেখাপড়া চলছে বলে জানায় আদর ও আরান।
নজরুল ইসলাম বাচ্চুর স্ত্রী হামিদা বেগম জানান, দু মেয়েকে অনেক কষ্ট করেই তাদের লেখাপড়া করাতে হয়েছে। টিউশনি করে সংসার চালাতে হয়। আর সরকারী তোলারাম কলেজে গানের শিক্ষক ও নারায়ণগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমীতে গানের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেই সংসার চালানো ও দ্ইু মেয়েকে বড় করেছেন।
বোমা হামলায় নিহত স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা ঘটনার দিন ব্যাংকে একটি চাকরির তদবির করতে গিয়েছিল শামীম ওসমানের নিকট। চাকরি হলে সংসারটি বেশ ভালোভাবে চলবে এমন প্রত্যাশাও সকলের।
বিকেলে অসুস্থ স্বামীর পা ব্যান্ডেজ করে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ফতুল্লা থানা মহিলা আওয়ামীলীগের আহবায়ক পলি বেগম। কিন্তু বোমা কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণ। তিন সন্তানদের মধ্যে এক ছেলে আর এক মেয়ে এলাকাতে একটি টেইলার্স দিয়ে কোনভাবে সংসারের হাল টানছে।
বিকালে শিশু মেয়ের জন্য কোন ব্র্যান্ডের দুধ আনতে হবে তা স্ত্রী আনোয়ারার কাছ থেকে জেনে নিয়ে বন্ধুর সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে যান মোঃ হানিফ নূরী। তিনি কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না। শিশু কন্যার খাবার আনতে ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কোন এক কারণে আওয়ামীলীগ অফিসে গিয়ে তিনি বর্বরোচিত বোমা হামলার শিকার হন। পরিবারের এক মাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে অসহায় পরিবারটি আজ দু’ চোখে অন্ধকার দেখছে। চরম হতাশার মধ্যে তারা হাবুডুবু খাচ্ছে।
নিধুরাম বিশ্বাসের ছেলে সানি বিশ্বাস বলেন, ‘বাবা নেই তাই পরিচয়হীন হয়ে গেছি। ১৬ জুন আসলেই সকলে যোগাযোগ করে আর না হলে কোন খোঁজ খবর নেয় না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই তিনি যেন এর বিচার করেন।’
নিহত পরিবারের সদস্যরা বলছেন, চন্দন শীল ১৫ সেপ্টেম্বর যখন মনোনয়ন পত্র জমা দিতে যান তখন তিনি বোমা হামলা দুই পা হারানো রতন দাস সহ আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবার যেহেতু তিনি চেয়ারম্যান হচ্ছেন তার পক্ষে সম্ভব নিহত পরিবারের মধ্যে যারা অসহায় তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের সহযোগিতা করা। এর আগে অজুহাত ছিল তার সামর্থ নাই। কিন্তু এবার নিশ্চয় আর অজুহাত দেখানোর সুযোগ নাই। কারণ জেলা পরিষদকে বিগত দিনে অসহায় অনেক পরিবারের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে। তাদের পক্ষে ২০ পরিবারের মধ্যে অসহায় পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া, সুন্দরভাবে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ না করে দিলে চন্দন শীল হবেন বেঈমান। মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়ে নিহত পরিবারের প্রতি চন্দন শীলের দায়িত্ববোধ কি শুধুই আইওয়াশ নাকি এবার বাস্তবে দেখা যাবে সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো কয়েকদিন। পরিবারের আশা, আগামী ১৬ জুনের আগেই চেয়ারে বসে অন্তত প্রথম উদ্যোগ নিবেন অসহায় পরিবারের দিকে। ১৬ জুন চেয়ারম্যানের গাড়ি থেকে নেমে শহীদ মিনারে সেই স্তম্ভে যখন আসবেন চন্দন শীল তখন যেন অন্তত পরিবারগুলো এবার কষ্টে না বরং স্বস্তির চোখের জ্বল ফেলতে পারে সেদিনের অপেক্ষায় সকলে।
আপনার মতামত লিখুন :