নারায়ণগঞ্জের বিএনপির রাজনীতিতে বেশ সজ্জন নেতা হিসেবেই পরিচিত মোস্তাফিজুর রহমান ভূইয়া দিপু যিনি ঐতিহ্যবাহী ভূইয়া পরিবারের উত্তরসূরী। বিএনপির সক্রিয় রাজনীতিক হলেও পর্দার আড়ালে থাকা এ দিপুকে ঠেকাতে বিগত দিনে দলের ভেতরে যেমন চলেছে নানা ধরনের পাহারসম বাধা তেমনি এখন ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের কাছেও লক্ষবস্তু হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে গত ৪ আগস্ট তাঁর ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানে ঘটেছে হামলার ঘটনা। তবে এটাই শুরু না বরং গাউছিয়া মার্কেটের অদূরে গোলাকান্দাইলে তার বাড়িতেও ঘটেছিল হামলার ঘটনা। সশস্ত্র সেই হামলার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বাৎসরিক মেজবান উৎসব। এবার দিপু ভূইয়ার সঙ্গে তাকে সঙ্গ দেওয়া রাজনীতিকেরাও রেহাই পাচ্ছে না। ইতোমধ্যে আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরেও জেলা যুবদলের আহবায়ক ও মুড়াপাড়ার সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক খোকনের বাড়িরে গেটের বিপরীতে গড়ে তোলা হয়েছে যুবলীগের কার্যালয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক মনিরুল ইসলাম রবির মতে দিপুর সামনে একটি রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রয়েছে। সে কারণেই তাকে রাজনৈতিক কারণেও টার্গেট করা হয়েছে। ৪ আগস্ট যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের লোকজন যেভাবে হামলা করেছে সেটা খুবই ন্যাক্কারজনক। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিনা কারণে বিনা উস্কানিতে এ ধরনের হামলায় আমরা উদ্বিগ্ন।
তিনি আরো বলেন, জেলা যুবদলের আহবায়ক খোকনের বাড়ির সামনে যে অফিস করেছে যুবলীগ সেটাও প্রশাসন ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে গায়ের জোরে করেছে। আদালতের নিষেধাজ্ঞা মানা হয়নি। সেখানে মন্ত্রীপুত্র গিয়ে যেভাবে বক্তব্য রেখেছেন তাকে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন উস্কানি পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এটাকে সাফ কথায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বলা চলে।
এদিকে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, শুধু রূপগঞ্জ না বরং নারায়ণগঞ্জের বিএনপির রাজনীতিতেও তলে তলে ফ্যাক্টর দিপু ভূইয়া। বিএনপির বিভিন্ন সহযোগি সংগঠনের শীর্ষ নেতারা এরই মধ্যে দিপু ভূইয়ার প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। গ্রুপিংয়ের রাজনীতিকে ঊর্ধ্বে রাখার কারণে দলের শীর্ষ নেতারাও দিপুর প্রতি বেশ সন্তোষ। তাছাড়া রূপগঞ্জের বিএনপি নেতা কাজী মনিরুজ্জামান ইতোমধ্যে পদ থেকে সরে গেছেন। রাজনীতিতেও বিমুখ। সে কারণে রূপগঞ্জ জেলার বিএনপির পুরো রাজনীতি এখন দিপুর নিয়ন্ত্রনে। বিএনপি ও এর সহযোগি সংগঠনের কমিটিগুলোতেও দিপুর অনুগামীরা জায়গা করে নিতে পারছে। তাছাড়া এক সময়ে বিমুখ থানা বিএনপির নেতারাও এখন দিপুর প্রতি আস্থা বাড়াচ্ছে। তাছাড়া আগামীতে রূপগঞ্জ আসনে এমপি পদে দিপু ভূইয়ার মনোনয়ন অনেকটাই নিশ্চিত। কারণ এ আসনে গতবার মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন তৈমূর আলম খন্দকার। গত ১৬ জানুয়ারী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজয়ের পর বিএনপি তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেন। ফলে রূপগঞ্জে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেতে দিপুর বিকল্প এখনো কেউ নিজেকে দাঁড় করাতে পারেনি। সে কারণেই তাকে ঠেকাতে চাপ সৃষ্টি করতেই একের পর এক হামলা করা হচ্ছে। তবে এতে করে দিপুর জনপ্রিয়তা কমার চেয়ে বরং বাড়বে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ রূপগঞ্জের সবগুলো এলাকাতেই ভূইয়া পরিবারের লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির একাধিক নেতা জানান, স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির নিয়ন্ত্রন নিয়ে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বেশ কাদা ছোড়াছুড়ি বা বিরোধ থাকলেও এগুলোতে গা ভাসান না দিপু। এ কারণেই প্রকাশ্য অনেক নেতার তল্পিবাহক আবার দিপুর সঙ্গে আড়ালে যোগাযোগ রাখেন। তাছাড়া দলের হাই কমান্ডের সঙ্গেও রয়েছে দিপুর সখ্যতা।
এদিকে দিপুর পক্ষে থাকার কারণে মুড়াপাড়ায় রূপগঞ্জে জেলা যুবদলের আহ্বায়ক গোলাম ফারুক খোকনের বাড়ির গেটের বিপরীতে জমিতে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কার্যালয় বা স্থাপনা নির্মাণ করতে আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরেও সেখানে কাজ চলমান আছে। এ অবস্থায় সেখানে ৩১ জুলাই কার্যালয় উদ্বোধন করে রীতিমত খোকনকে কড়া ভাষায় হুশিয়ারী দিয়েছেন মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে গাজী গোলাম মর্তুজা পাপ্পা।
গোলাম ফারুক খোকন বলেন, ২২ মে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আমার বাড়িতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা করে ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। এসময় সন্ত্রাসীরা কয়েক রাউন্ড ফাকা গুলিবর্ষণ করে এবং কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এর পর থেকেই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন আমাদের বাড়ির আশেপাশে মহড়া দিচ্ছে। এখন সেখানে তারা যুবলীগের অফিস বানাচ্ছে। ২২ জুন আমাদের লোকজন বাধা দিলে প্রথমে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে আবার পুলিশের উপস্থিতিতে কাজ শুরু হয়।
এদিকে ৪ আগস্ট বিকাল ৩ টায় উপজেলার ভুলতায় দিপুর অফিস ও তার মালিকানাধীন মার্কেটের বণিক সমিতির অফিসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপির দাবি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ ও যুবমহিলা লীগের নেতাকর্মীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ও রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান হুমায়ুন বলেন, ভোলা ছাত্রদলের সহসভাপতি নুরুল আমিন হত্যার বিচারের দাবিতে রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ভুলতা এলাকায় বিক্ষোভ করার কথা ছিল। সংঘর্ষের আশঙ্কায় পরে সেই কর্মসূচি বাতিল করা হয়। সম্ভবত এ খবরে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিকদার, নাজমুল হাসান সবুজ, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ভূঁইয়া, যুবলীগ নেতা আলামিন ও উপজেলা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শীলা রাণী পালের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা ভুলতা এলাকায় সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। একপর্যায়ে উত্তেজিত নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় বিএনপির কার্যকরী পরিষদের সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপুর অফিসে হামলা ও ভাংচুর চালায়। পরে তার মালিকানাধীন গাউসিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির অফিস ভাংচুর করে।
রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব বাছির উদ্দিন বাচ্চু বলেন, কোন কারণ ছাড়াই বিএনপি নেতা দিপু ভূঁইয়ার অফিসে ও তার মালিকানাধীন মার্কেটের বণিক সমিতির অফিসে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে। আমরা এ ঘটনার নিন্দা ও বিচার কামনা করছি।
একই দিন রাতে ভোলাবোতে সামাদের বাড়ির সামনে এ হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি। রনি জানান, এটা কেমন রাজনীতি। পাকিস্তানিদের মত দেশের নাগরিকদের ধরে ধরে মারা হচ্ছে। সামাদ ও সোহেলকে পিটিতে আহত করেছে যুবলীগের নেতাকর্মীরা। আমি এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করছি।
এর আগে ২০১৫ সালে ভূইয়া দিপুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে রেখেছিল ছাত্রলীগের বাহিনী। সে সময়ে দিপু ভূইয়াকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারধর ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতের শিকার হন ছাত্রদলের সালাউদ্দিন, রাকিব সহ আরো কয়েকজন। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর দুপুরে গোলাকান্দাইলে দিপুর বাড়িতে আলোচনা সভার আয়োজন করে উপজেলা যুবদল। দুপুর উপজেলা যুবদলের গোলাম ফারুক খোকনের নেতৃত্বে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের গোলাকান্দাইল এলাকায় একটি র্যালী বের করে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা, গোলাকান্দাইল, বলাই খাঁ, সাওঘাট এলাকা প্রদক্ষিণ শেষে র্যালিটি কাচারীবাড়িতে এক সংক্ষিপ্ত সভার আয়োজন করলে উপজেলা ছাত্রলীগের ৪০-৪৫জন নেতাকর্মী হামলা চালায়। এক পর্যায়ে পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের লোকজন দিপুর বাড়ির বেস্টনীর ভেতরে প্রবেশ করে লাঠিসোটা নিয়ে একের পর এক গাড়ি ভাঙচুর ও বাড়িতে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ওই সময়ে দিপু বাইরে এসে নিজের দলের লোকজনদের উদ্ধার করতে আসলে ছাত্রলীগের লোকজন প্রথমে বাধা দেয়। কিন্তু দিপু তার পরেও নেতাকর্মীদের উদ্ধার করতে এলে দুই ক্যাডার দিপুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। তখন তাদের মধ্যে বাকবিতন্ডাও ঘটে।
এর তিন বছর পর ২০১৮ সালে দিপু ভূঁইয়ার রূপগঞ্জের বাড়িতে বিএনপির ঈদ পুনর্মিলনী ও ৩০ হাজার লোকের জন্য আয়োজিত মেজবানী অনুষ্ঠান পুলিশ বন্ধ করে দেয়। এর পর থেকে আর সেটা আয়োজন করা যায়নি। তখন বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি তখন বলেন, এ সরকার কতটা নির্যাতন করেছে যে প্রতি বছর দিপু ভূঁইয়ার বাড়িতে মেজবান হয়, এবারো ৩০ হাজার লোকের আয়োজন ছিল কিন্তু সেই আয়োজনকে প্রশাসন দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটা দুঃখজনক। এতো নির্যাতন সহ্য করেও এখনো মাঠে আছেন তারা। এজন্য ধন্যবাদ জানাই।
প্রসঙ্গত ওই বছরের ২৪ আগস্ট রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল বাসভবন মাঠে নিজ উদ্যোগে বিএনপির ঈদ পূণর্মিলনী ও গরীব অসহায় ৩০ হাজার লোকের জন্য মেজবানী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন দিপু যা তিনি দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে করে আসছিলেন। কিন্তু একদিন আগে রাত ১২টায় রান্নার কাজ চলাকালে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ অনুষ্ঠানে গিয়ে বন্ধ করে দেন।
আপনার মতামত লিখুন :