নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির কমিটি ঘোষণার পর থেকেই বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। একের পর এক ঘটনায় তারা বিতর্কিত হয়েই আসছেন। কমিঠি গঠন থেকে শুরু করে সকল কিছুতেই বিতর্কের জন্ম দিচ্ছেন। এবার দলীয় আন্দোলন সংগ্রামের খরচ হিসেবে পাওনা টাকাও মেরে খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ টিপুর বিরুদ্ধে। কেন্দ্রের কাছ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে আনা ৬ লাখ টাকায় তার বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
দলীয় সূত্র বলছে, সরকারের পদত্যাগের দাবীতে টানা হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। আর এসকল কর্মসূচিকে সফল করার জন্য তৃণমূল পর্যায়কে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। সে লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মাঝে খরচ করার জন্য আর্থিক সহযোগিতাও করেছে।
তারই অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির কাছে পর্যায়ক্রমে ৬ লাখ টাকার এসেছে। যে টাকাগুলো সংগ্রহ করেছেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু। কিন্তু সেই টাকার কোনো একটি টাকাও খরচ করছেন না বলে অভিযোগ করছেন মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
শুধুমাত্র অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপুর সাথে থেকে কর্মসূচিতে যোগদান করেই তারাই এই টাকা কিছু অংশ পেয়ে থাকেন। এর বাইরে কোনো টাকাই খরচ করছেন বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের।
নারায়গঞ্জ মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক সাখাওয়াত ইসলাম রানা বলেন, দলীয় আন্দোলন সংগ্রাম কর্মসূচি সফল করার জন্য কেন্দ্র থেকে বিপুল সহযোগিতা আসছে। এই পর্যন্ত ৬ লাখ টাকা আসছে বলে শুনেছি। কিন্তু এই টাকার মধ্যে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দল পাঁচটা পয়সাও পাই নাই। পাঁচটা পয়সা দিয়েও মহানগর বিএনপি আমাদের সহযোগিতা করছে না। সব টাকা আবু আল ইউসুফ খান টিপু ভাই নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি রোজ হিসেবে সহযোগিতা করেন।
একই ভাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু সবসময় এরকম করে থাকেন। কেন্দ্র করে যত রকমের সহযোগিতা আসে সব তিনি একাই ভোগ করে থাকেন। আমাদের বিন্দুমাত্র সহযোগিতা করেন না। তিনি নিজে টাকা আত্মসাত করে বিপুল পরিমাণ টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন।
এর আগে ঢাকার বিভিন্ন কমসূচিকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় বিএনপির কাছ থেকে দুইবারে ৮ লাখ টাকা অনুদান এনেছিলেন সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু। নেতাকর্মীদের মধ্যে সেই টাকা বন্টনের কথা বলা হলেও সেই টাকা বন্টন না করেই নিজের পকেটবন্দী করেছে আবু আল ইউসুফ খান টিপু।
মহানগর বিএনপির নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ২৮ জুলাই শুক্রবার রাজধানীতে বিএনপি মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ওই সমাবেশের আগে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির কাছে নগদ ৫ লাখ টাকা পাঠানো হয়। নির্দেশ দেওয়া হয় মহানগর বিএনপি যেন টাকার যথার্থ ব্যবহার করে লোকজনের সমাগম ঘটায় সেই সঙ্গে সহযোগি সংগঠনগুলোকেও যেন সমবন্টন করে টাকা দেওয়া হয়।
সেই সাথে আগের দিন ২৩টি ইউনিট কমিটিকে ৫ হাজার টাকা করে ১ লাখ ১৫ হাজার ও ১০টি সহযোগি সংগঠনকে সমসংখ্যক টাকা দেওয়া হয়। কেন্দ্রের টাকা দেওয়ার খবরটি প্রচার হয়ে গেলে সহযোগি সংগঠন ও বিএনপির শীর্ষ নেতারাও এর সমবন্টন করার দাবী তুলেন। কিন্তু সদস্য সচিব সেটা করেননি। সেই সাথে টাকার হিসেবও নেতাকর্মীদের বুঝাননি। ২৮ জুলাই ঢাকায় সমাবেশে লোকজন যোগ দিলেও পরে কাউকে এ টাকার ভাগ দেওয়া হয়নি। টাকা ঢুকে যায় শীর্ষ নেতাদের পকেটে।
এর আগেও ৩ লাখ টাকা এনেছিলেন আবু আল ইউসুফ খান টিপু। সেটারও কোনো হিসেব পাননি মহানগর বিএনপির নেতারা। নেতাকর্মীদের মাঝে বন্টনও করা হয়নি।
তার আগে গত ১৫ জুলাই নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। সেই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনুদানও সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সম্মেলনের আগ মুহুর্তে সম্মেলন স্থগিত করা হয়। তবে সম্মেলন স্থগিত হলেও সেই অনুদানের টাকা ফেরত দেয়া হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়করা বলেছিলেন, সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ টিপু দলের পদবী পেয়ে এখন ব্যবসায় নেমেছেন। ইতিমেধ্যে তিনি একটি ফ্লাটের মালিক হয়েছেন। দলীয় আন্দোলন সংগ্রামের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে তিনি টাকা সংগ্রহ করেন। কিন্তু সেই সাথে দলের নেতাকর্মীদের জন্য খরচ করেননি তিনি। তিনি কারও সাথেই ভাল ব্যবহার করেন না। সকলেই তার আচরণে অতিষ্ঠ। তার জন্য রাজনীতি করতে ইচ্ছা হয় না।
বিএনপির কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সদস্য মাহমুদুর রহমান স্লোগান দিতে দিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেও তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য আবু আল ইউসুফ টিপুর কাছে টাকা চাইলে তিনি প্রথমে টাকা দিতে অস্বীকার করেন। পরে কিছু টাকা দিলেও সেটা ছিলো একেবারেই নগন্য।
যুগ্ম আহ্বায়করা আরও জানিয়েছিলেন, সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ টিপু অতীতেও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন। তিনি বক্তব্যে বলেন দলের জন্য জীবন দিবেন। কিন্তু আন্দোলন সংগ্রামে কোনো বাধা আসলে তিনি সবার আগে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় না। অতীতে কয়েকবার দল থেকে বহিস্কৃত হয়েছে। বিএনপির বিরুদ্ধে বিএনএফ প্রতিষ্ঠা করেছে। বিএনপির জন্য তার নূন্যতম ত্যাগ নেই।
জানা যায়, ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির ৪১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে অ্যাডভোকেট মো. শাখাওয়াত হোসেন খান এবং সদস্য সচিব হিসেবে অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আর এই কমিটি ঘোষণার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই সাথে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি থেকে ১৫ জন নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এখনও সেই বিভক্ত অবস্থায় রয়েছে মহানগর বিএনপি।
এদিকে ২০১৬ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী মহল হতে ২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছিলেন সহযোদ্ধা টিপু। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মাঝের কয়েক বছর বিরূপ সম্পর্ক থাকলেও গত সেপ্টেম্বরে মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটি দেয়ার সময়ে মিলন ঘটে।
তবে বছর পেরিয়ে যাওয়ার মধ্যেই কমিটির বিরুদ্ধে আবু আল ইউসুফ খান টিপুর বিরুদ্ধে একের পর এক অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারীর অভিযোগ উঠেছে। সেই সাথে নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি কমিটি ঘোষণার পর টাকার বিনিময়ে কমিটি দেয়ার অভিযোগও রয়েছে টিপুর বিরুদ্ধে।
আপনার মতামত লিখুন :