একেএম শামীম ওসমান এবং মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন দুজনই নারায়ণগঞ্জের অন্যতম ঝানু রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। এদের মধ্যে একজন ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং আরেকজন বর্তমান সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও সর্বশেষ জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির আহবায়ক হওয়ার মধ্য দিয়ে আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন গিয়াস উদ্দিন। এরপর থেকেই গিয়াসকে নিয়ে শামীম ওসমানকে বেশ সিরিয়াস দেখা যায়। বিভিন্ন কর্মসূচিতে বক্তব্যকালে গিয়াসকে নিয়ে সমালোচনা করতে দেখা যায় তাকে। কারণ দলের নেতার চেয়ে ব্যক্তি গিয়াস বেশ শক্তিশালী। গিয়াসের অতীত রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করলে এমনই ধারণা পাওয়া যায়। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে শুরু করে কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো জাতীয় পার্টি, কখনো আবার আওয়ামী লীগ করেছেন। যখনই যে দলে গেছেন তখনই তিনি সফল হয়েছেন। বাবরার দল পরিবর্তনে তার কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং তিনি সফল হওয়ার জন্য দল পরিবর্তন করতেন। এর আগে ২০০১ সালে নমিনেশন না দেওয়ায় আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়ে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হোন। আগামী নির্বাচনের আগে আবারও গিয়াসের দল পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি বক্তব্য রাখেন শামীম ওসমান। এরপর থেকেই গিয়াসের দল পাল্টানোর বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। তবে নতুন করে গিয়াসের এমন দল পাল্টানোর বিষয়ে মোটেও খুশি নন শামীম ওসমান। বরং তিনি চিন্তিত। কেননা কোনো স্বার্থ না থাকা ছাড়াই গিয়াস দল বদলানোর মানুষ না।
এর আগে গত ১ নভেম্বর বিকেলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্কে আওয়ামী লীগের এক প্রস্তুতি সভায় মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে শামীম ওসমান বলেন, নারায়ণগঞ্জে বিএনপির এক প্রেসিডেন্ট আছেন, খবর নিয়ে একটু দেখবেন তিনি অন্য কোনো দলে যাচ্ছেন কি না। তৃণমূলে তো যেতে পারবেন না, তৈমূর আলম খন্দকার লাথি দিয়ে বের করে দেবেন।” তবে শামীম ওসমানের এই বক্তব্য মিথ্যা উল্লেখ করে গিয়াস বলেন, তার এখন মাথা ঠিক নাই। সে দীর্ঘদিন ধরেই খেই হারিয়ে ফেলেছেন। যখনই সে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন তখনই সে ২০০১ সালের সেই ভয়ংকর দিনগুলোর কথা মনে করে আমাকে দেখে। সে কারণে আউল ঝাউল করে কথা বলে। তার এইসব কথা জনগণ গুরুত্ব দেয় না। বরং এটা যে পাগলের প্রলাপ তা সবাই জানে। তার বর্তমানে কোনো জনভিত্তি নেই। তাই যার জনভিত্তি আছে তার বিরুদ্ধে তখন সে বক্তব্য রাখে। মূলত আতঙ্ক ভয় থেকেই সে আমাকে নিয়ে এমন কথা বলে। তার কারণে দলের অনেক মানুষ লজ্জিত। তারা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। আমাদের কাছে তাদের অনেক নেতাকর্মী বলে। তার এমন কথাবার্তায় আমরাও লজ্জা পাই। সে দলের সাংগঠনিক কোনো পর্যায়ে নেই। তিনি একজন অনির্বাচিত ব্যক্তি। তাই তার মুখ দিয়ে যে কিছুই বলাই স্বাভাবিক।
এদিকে একসময় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি ছেড়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যোগ দেন গিয়াস উদ্দিন। পরে ১৯৭২/৭৩ সালে গিয়াস উদ্দিন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক হয়। ওই সময় নজরুল ইসলাম ভুইয়া ছিল সভাপতি। ৭৫ পরবর্তীতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পর এলাকাবাসীর চাঁদার টাকায় সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ৮০’র দশকে আওয়ামী লীগ থেকে এরশাদের জাতীয় পাটিতে যোগ দেন গিয়াস উদ্দিন। পরে সদর উপজেলা (ফতুলা-সিদ্ধিরগঞ্জ) নির্বাচনে দলের প্রভাবে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত গিয়াস উদ্দিন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮৭ সালে প্রভাব খাটিয়ে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে ১ দশমিক ৯৭ একর জমি লীজ নিয়ে পাথর ব্যবসা শুরু করেন গিয়াস উদ্দিন। এরশাদের আমলে দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন গিয়াস উদ্দিন। পরে এরশাদের জাতীয় পাটিতে থেকে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এরশাদের পতনের পর অনেকটা বেকায়দায় পড়ে যান গিয়াস উদ্দিন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের মাঝামাঝি গিয়াস উদ্ধিন সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল এলাকায় গড়ে তোলেন জিআর টেক্সটাইল মিল। এরশাদের পতনের পর কিছুদিন রাজনীতিতে নিস্ক্রীয় থাকার পর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে-পায়ে ধরে ১৯৯৪/৯৫ সনে যোগ দেন আওয়ামী লীগে এবং তদবির করে কৃষক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির পদ দখল করে নেন তিনি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগরে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমানের বিপক্ষে অবস্থান নেয় গিয়াস উদ্দিন। পরে শামীম ওসমান এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় গিয়াস উদ্দিনের। এতে গিয়াস উদ্দিন শেল্টার নেয় কৃষক লীগের সভাপতি ও ভুমি প্রতিমন্ত্রী রাসেদ মোশারফের। তাকে ব্যবহার করে গিয়াস উদ্দিন অবৈধ উপায়ে নানা সুযোগ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তিনি তার কাঁচপুরে পাথর ব্যবসার আড়ালে শীতলক্ষ্যা নদী দখলের প্রতিযোগিতায় নামে। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় থেকে গিয়াস উদ্দিনের পাথর ব্যবসা উচ্ছেদ করতে যায়। কিন্তু ওই সময়ের ভুমি প্রতিমন্ত্রী রাসেদ মোশারফের প্রভাবের কারনে গিয়াস উদ্দিনের পাথর ব্যবসা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই কোটি টাকা ব্যায়ে গিয়াস উদ্দিন শিমরাইল এলাকায় কাসসাফ শপিং সেন্টার নামে বহুতল মার্কেট গড়ে তোলেন। পরে আবারও দল পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নেয় গিয়াস উদ্দিন। এক পর্যায়ে ২০০১ সালের ১৪ আগস্ট গিয়াস উদ্দিন কৃষক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির পদ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেয়। পরে এফবিসিআইসির নেতা শিল্পপতি মোহাম্মদ আলীর সুবাধে প্রতীক বরাদ্ধের আগের দিন নাটকীয়ভাবে ৬ সেপ্টেম্বর গিয়াস উদ্দিন দলীয় মনোনয়ন পেয়ে যান এবং ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে পরাজিত করে গিয়াস উদ্দিন এমপি নির্বাচিত হয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অঙ্গনে রাতারাতি আলোচনায় ওঠে আসেন।
বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সাথে টক্কর দেয়ার মত নেতা হচ্ছেন গিয়াস উদ্দিন। এদিকে শামীম ওসমানকে কিভাবে পরাজিত করতে হবে তা গিয়াস উদ্দিনের ভালো করেই জানা। এদিকে অতীতে বিএনপি নিয়ে শামীম ওসমানের এমন মাথাব্যাথা দেখা যায়নি। বর্তমান গিয়াসকে নিয়ে তার বাড়তি মন্তব্যেই প্রমাণ হয় তাকে নিয়ে মাথাব্যাথা রয়েছে। আর অঘোষিতভাবেই শামীম ওসমান চাচ্ছেন গিয়াস ঠেকাও কার্যক্রম পরিচালনা করতে।
আপনার মতামত লিখুন :