‘গত ১৫ দিন ধরে পলাতক। কখনো এ এলাকাতে কখনো ওই এলাকাতে। আত্মীয় স্বজনেরাও ঠিকমত জায়গা দিতে চায় না ভয় পায়। বন্ধুদের অনেকেই নিজের বাসায় উঠায় না পরিবারের ভয়ে। কখনো এ হাসপাতাল কখনো ওই হাসপাতাল। আবার কখনো মসজিদে ঘুমিয়ে দিন পার করছি। এক বেলা ঠিকমত খাই তো ২ বেলা ঠিকমত খেতে পারি না। মোবাইল ফোনও সব সময়ে চালু থাকে না। চরম কষ্টে দিন পার করছি। আর তাদের দেখলাম ফাইভ স্টার হোটেলে এসি রুমে ঘুমায়।’
৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের একজন বিএনপি নেতা এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। তিনি নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চলমান আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের বেশীরভাগ কর্মী খুব অসহায় অবস্থায় আছে। চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে। মামলার ভয়ে এলাকাতে নিজ বাড়ি ছাড়া দিনের পর দিন। শুরুতে নেতারা খোঁজ নিলেও এখন নেতারাও নিজেদের আড়াল করে রেখেছে।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে পুলিশের উপর বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনায় এজাহারনামীয় তিনজনসহ ১০ নেতাকর্মীকে রাজধানী ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। ২ নভেম্বর সকালে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় র্যাব।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের ইন্ধনে অবরোধের প্রথম দিন ৩১ অক্টোবর আড়াইহাজারে মহাসড়কে নাশকতা, সহিংসতা ও পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে রাজধানীর ৫ তারকা হোটেল ওয়েস্টিন থেকে ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশকে কুপিয়ে সহিংসতা, নাশকতা করে ৩১ অক্টোবর ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে হোটেল ওয়েস্টিনে অবস্থান নেয় তারা। নাশকতা সৃষ্টি ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ইন্ধনদাতা হিসেবে আর কারা কারা জড়িত আছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাব বলছে, ৩১ অক্টোবর আড়াইহাজারে পুলিশের ওপর হামলা, নাশকতা সৃষ্টিকারী এবং সহিংসতাকারীদের চিহ্নিত করতে আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজের সূত্র ধরে হামলাকারীদের অবস্থান চিহ্নিত করতে কাজ শুরু হয়। তথ্যপ্রযুক্তির পাশাপাশি বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে তাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয় র্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মামলার এজাহার নামীয় আসামি বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুকুল ইসলাম রাজীব (৫৩), আড়াইহাজার থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. জুয়েল আহমেদ (৫২) ও আড়াইহাজার পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আরমান মোল্লা (৪৬), আড়াইহাজার থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান (৫৪), মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি মো. মাসুম শিকারী (৪৫), আড়াইহাজার থানা বিএনপি যুগ্ম সম্পাদক মো. শফিউদ্দিন ভূঁইয়া (৪৮), আড়াইহাজার থানা বিএনপি সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শফিউদ্দিন ভূঁইয়া (৫১), আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপি সভাপতি মো. ইউসুফ আলী ভূঁইয়া (৬৯), আড়াইহাজার থানা যুবদলের ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক হাবিবুর রহমান সেলিম (৪৮) ও আড়াইহাজার থানা বিএনপির সহ সভাপতি মো. শাকিল মিয়া (৪০)।
গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে র্যাব জানায়, ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতেই এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে টার্গেট করেই তারা নাশকতার পরিকল্পনা নিয়েছিল তারা। যার ধারাবাহিকতায় পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশকে কোপানোর ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পেতে ইন্ধনদাতা সেই বিএনপি নেতার মদতে গুলশানের ৫ তারকা হোটেলে ঠাঁই হয় তাদের। ৩১ অক্টোবর ঘটনা ঘটিয়েই পরে ঘটনাস্থল থেকে সটকে গিয়ে রাজধানীতে ঢুকে পড়ে এবং গুলশানে গিয়ে অবস্থান নেয় তারা। তারা ভেবেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন হোটেলে অবস্থান নিলেও পাঁচ তারকা হোটেলে কোনও ধরনের অভিযান পরিচালনা করবে না, বা তাদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া পাঁচ তারকা হোটেলে কিছু দিন আয়েশী জীবনযাপন করা যাবে। এসব কারণেই বিএনপির সেই নেতার ইন্ধন এবং আর্থিক মদতের কারণে ৩১ অক্টোবর রাত থেকে তারা হোটেল ওয়েস্টিনে অবস্থান শুরু করে।
র্যাব বলছে, গ্রেফতারকৃত ১০ জন সরাসরি পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে জখম করার সঙ্গে জড়িত। হোটেলে অবস্থান করেও তারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নাশকতা ও সহিংসতার পরিকল্পনা করে আসছিল। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পাঁচ তারকা হোটেলে নাশকতাকারীদের কারা অবস্থান করার সুযোগ করে দিয়েছিল, কারা রুম বুকিং করিয়ে দিয়েছিল, কারা অর্থ দিয়েছিল এসব বিষয় গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতেই ৫ তারকা হোটেলকে বেছে নেয় তারা। গ্রেফতারকৃতদের দিয়ে নাশকতা করানোর পাশাপাশি পাঁচ তারকা হোটেলে অবস্থান করতে সহায়তাকারীদের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
উল্লেখ গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচরুখী বাজার এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান বিএনপির নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে তিনজন পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে জখম করেন তারা। এ ঘটনায় কমপক্ষে ২০ জন আহত হন। আহত তিন পুলিশ সদস্য হলেন- পরিদর্শক হুমায়ুন কবির, সহকারী উপপরিদর্শক মো. মতিন ও কনস্টেবল মো. নুরুল।
আড়াইহাজারে পুলিশকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা, গাড়ি ভাংচুর, সড়কে অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ বিএনপি-জামায়াতের ৬০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা করেছে পুলিশ।
আপনার মতামত লিখুন :