নারায়ণগঞ্জ শহরে কোনোভাবেই যেন হোন্ডা বাহিনীকে থামানো যাচ্ছে না। তারা একের পর অপকর্ম করেই বেড়াচ্ছেন। শহরের এই বহুল আলোচিত সমালোচিত হোন্ডাবাহিনী নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বিভিন্ন সভা সমাবেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসলেও কোনো কিছুই কাজে আসছে না।
তাদের নাকের ডগা দিয়েই অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে এই হোন্ডা বাহিনী। ওসমান ভ্রাতৃদ্বয় বিভিন্ন সভা সমাবশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গলা উঁচিয়ে বক্তব্য দিলেও কাজের বেলায় যেন কিছুই না। তাদের একের পর এক হুঁশিয়ারী জেহাদ কিংবা নতুন নতুন পরিভাষা ব্যবহার করে দেয়া ঘোষণা সবকিছুই যেন শুধু বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। এখনই তাদের এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন মনে করছেন নগরবাসী।
স্থানীয় সূত্র বলছে, শহরে প্রায়শই দাপিয়ে বেড়ায় অর্ধশতের অধিক মোটরসাইকেল। তবে যেসব এলাকাতে প্রয়োজন দাপট খাটানো সেখানেই যৌথ মহড়া চলে। কখনো সেটা হয় কোন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান ও গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের সামনে। দলবল নিয়ে ওই বহরে সাধারণত একজন মটরসাইকেল চালায় আর পেছনে থাকে অন্য একজন। এখন মটরসাইকেল বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে প্রাইভেটকারও।
সবশেষ নারায়ণগঞ্জের আলোচিত হোন্ডা বাহিনীর মূল নেতৃত্বদানকারী পিজা শামীমের বিরুদ্ধে আবারও অন্যের সম্পত্তি ও ফ্যাক্টরি দখলের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। যে পিজা শামীমকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে থাকে তারই পরিবারের সদস্যরা। এবারও পিজা শামীম তার বাহিনী নিয়ে দিনে দুপুরে অন্যের জমির উপড় দেয়াল নির্মাণ ফ্যাক্টরির মালামাল লুট করেছেন। এসময় ভুক্তভোগীরা ৯৯৯ ফোন করেও কোনো প্রতিকার পাননি। গত ২২ অক্টোবর দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ফতুল্লার বিসিক শাসনগাঁওয়ের দেওয়ান বাড়ি এলাকার মো. ইমরান দেওয়ান এই অভিযোগ করেন।
মো. ইমরান দেওয়ান অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাতের বেলা আমার নিজ বাড়িতে ১ কোটি টাকা চাঁদা চাইতে এসেছিলো কিছু চিহ্নিত চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী। যদি চাঁদা না দেই তাহলে তারা ফতুল্লার বক্তাবলী ইউনিয়নের চর রাজাপুর এরাকায় আমার ১৭ শতাংশ সম্পত্তির উপর ফ্যাক্টরি দখল নিবে এবং আমার প্রাণ নাশের হুমকি দেয়। এই ঘটনায় থানায় আমি একটা অভিযোগ দায়ের করি।
সন্ত্রাসীরা হলো শাহীন, হামিদ প্রধান, নাসির, পিজ্জা শামীম সহ আরও অজ্ঞাত ২০ থেকে ২৫ জন। কিন্তু এই অভিযোগ করার পর পুলিশ কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় সন্ত্রাসীরা গত ১৯ অক্টোবর বিকেলে নাম উল্লেখিত অভিযুক্তরা দেশীয় অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অজ্ঞাতনামা ৩০ থেকে ৩৫ জন আমার ফ্যাক্টরির ভাড়াটিয়াদের মারধর করে বের করে দেয়। যে বাহিনীর মূল নেতৃত্বে ছিলেন পিজা শামীম। সেই সাথে জোরপূর্বক ফ্যাক্টরির মেইন গেইটের সামনে ইট ও সিমেন্ট দিয়ে পাকা দেয়াল নির্মাণ করে। আমার ফ্যাক্টরির প্রায় ৩৫ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ঢেউটিন ও প্রোফাইল টিন এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের যেন প্রমাণ না থাকে সেজন্য সিসি ক্যামেরা ডিভিআর মেশিন ভেঙ্গে ফেলে।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে এক সময়ে হোন্ডাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমান। তিনি না থাকলে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে আকতার নূর, লিমন, নাসির, আমির, বারিশ সহ কয়েকজনকে সেই নেতৃত্বে দেখা গেছে। তবে এবার সেই বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন আলী হায়দার শামীম ওরফে পিজা শামীম। তিনি এখন নতুন গডফাদার হিসেবে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছেন। প্রতিদিন তার নেতৃত্বে শহরের বিভিন্ন স্থানে হানা দেওয়া হচ্ছে। তার গাড়িতে চড়ে বিভিন্ন জনকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও আছে। তার বাড়িতে নিয়মিত লোকজন যাচ্ছে নানা ধরনের বিচার শালিস নিয়ে। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তিনি এক পক্ষের হয়ে কাজ করে দিচ্ছেন।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান একের পর এক বিভিন্ন সভা সমাবেশে সন্ত্রাসী হোন্ডাবাহিনীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসকল হুঁশিয়ারির কোনোটাই যেন কাজে আসছে না। তিনি পরপর কয়েকটি সভায় হাম্মাজান, খান সাহেব এবং সবশেষ মাস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তারপরেও একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেই যাচ্ছে। সেলিম ওসমানের প্রশংসিত বক্তব্যে বারবার কলঙ্কের তিলক লেপন করে দেয়া হচ্ছে।
গত ৩০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের নবম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পুরান বন্দর চৌধুরী বাড়ি এলাকার নাসিম ওসমান মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গনে তাঁর পরিবারের পক্ষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
আর এই দোয়া মাহফিলে বক্তব্য রাখতে গিয়ে একেএম সেলিম ওসমান বলেন, এই বন্দর আপনাদের প্রয়াত নেতা নাসিম ওসমানে হাতে গড়া। এই বন্দরে কোন প্রকার সাইনবোর্ড লাগানোর ব্যবসা ছিল না। পুরোপুরিভাবে সাইনবোর্ড লাগানোর ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নতুন করে এখন কেউ কেউ সাইনবোর্ড ব্যবসা করতে শুরু করেছে। প্রতি মহল্লায় মহল্লায় মাস্তান তৈরি হয়েছে। আমি প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, প্রতিটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরসহ সকল জনপ্রতিনিধিদের কঠোরভাবে নির্দেশনা দিচ্ছি, আপনারা নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলুন। তাহলে দেখবেন কোন এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থাকবেনা। জমিতে সাইনবোর্ড ব্যবসা থাকবেনা। প্রয়াত নাসিম ওসমান বন্দরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে গেছেন তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
তবে তার এই বক্তব্যের কয়দিন আগেও বন্দর ঘটে গেছে কলঙ্কিত ঘটনা। সেখানে একটি পরিবার হোন্ডাবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। গত ১৬ মার্চ দুপুরে সাড়ে ১২টায় বীর মুক্তিযোদ্ধ নাসিম ওসমান সেতুর পূর্ব পাশে শীতলক্ষ্যার তীরে বন্দর উপজেলার ফরাজিকান্দা বাজারের পাশে ওই ঘটনা ঘটে। আক্রান্ত পরিবার হলো রাইসুল হক। তিনি ২০০২ সালে মারা যান। এর আগে তিনি টানা বেশ কয়েকবার বন্দরের কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি সদর জাতীয় পার্টির সভাপতিও ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন।
রাইসুল হকের ছেলে মনিরুল হক পারভেজ জানিয়েছিলেন, আমাদের জমিতে এসে সাইনবোর্ড গেঁথে দিয়ে যায়। কে বা কারা এটা উঠিয়ে দেয়। পরে ১৪ মার্চ এসে আমাদের বাড়িতে ৩০ থেকে ৪০টি মটরসাইকেলে করে লোকজন এসে হুমকি দেয়। পরে ১৬ মার্চ আমাদের জমি দখল করার জন্য শতাধিক লোকজন এসেছিল। তাদের অনেকেই এসেছিল মটরসাইকেলে করে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ফিল্মী স্টাইলে আমাদের উপর গুলি ছুড়তে থাকে। এতে আমার পায়ে গুলি লাগে। ওই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল পিজা শামীম। মূলত তিনিই এ দখলের চেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছে।
এই ঘটনার কয়দিন পরই পারভেজ মারা গেছেন।
এর আগে গত ৬ জানুয়ারি বন্দরে মহানগর জাতীয় পার্টির কার্যালয় উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে সেলিম ওসমান বলেছিলেন, বন্দরে সন্ত্রাস ছিল না। পুনরায় বন্দরে সন্ত্রাস বেড়ে উঠেছে। এমন কোনো মানুষ নাই যার কাছে চাঁদা দাবী করা হয় না। কোনো এক খান সাহেব এখানে লুটতরাজ চালাচ্ছেন। আমি কোনো দল বুঝি না কোনো ভালবাসা বুঝি না ছোট ভাই বুঝি না বড় ভাই বুঝি না বাপ বুঝি আমি যদি জীবিত থাকি বন্দরের মানুষ গত বছরের যেমন নিশ্চিন্তে ছিল এখনও নিশ্চিন্ত থাকবে।
ওসমান পরিবারের হাতের পাঁচটা আঙ্গুল সমান নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছি হাম্বা গ্রুপ ভাই সাহেব গ্রুপ যদি আপনারা মনে করেন তারা ওসমান পরিবার; ওসমান পরিবারের হাতের পাঁচটা আঙ্গুল সমান নয়। সুতরাং সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে এমন কোনো কাজ যদি কেউ করতে আসে আমার বন্দরে আমার নারায়ণগঞ্জে তাহলে সেলিম ওসমানের জীবন গেলে জীবন যাবে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না।
তার আগে গত ৩ জানুয়ারি রাতে শহরের বাধন কমিউনিটি সেন্টারে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্টিজের ৩৫ তম বার্ষিক সাধারণ সভার আয়োজন করা হয়।
আর এই সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে সেলিম ওসমান বলেছিলেন, বর্তমানে কিছু উশৃঙ্খল ছেলের জন্ম হয়েছে এখানে সেখানে আবার নেত্রীর কথা বলা হয়। সেই নেত্রীকে আবার বলে হাম্মাজান। হাম্মাজান যেই হোক না কেন কোনো অবস্থায়ই কোনো ব্যবসায়ীর ক্ষতি করা যাবে না। ব্যবসায়ীরা যদি হাম্মাজানের ডরে পকেট থেকে পয়সা দিয়ে দেন আপনাদের থেকে বড় দোষী আর কেউ হবে না। আবার দাঁড়িয়েছে আরেক গ্রুপ ভাইজান গ্রুপ। মোটরসাইকেল দেয়া হয়। কে কিভাবে কোথা থেকে মোটরসাইকেল কিনল, কিভাবে মোটরসাইকেল রাস্তায় নামে কিভাবে বিকেএমইএর ফ্যাক্টরি ফ্যাক্টরিতে জুট ব্যবসার সৃষ্টি হয় যেটা নাকি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিল। আমি এখনও মরি নাই ভয় পাবেন না। ও যদি আমার বাপও হয় তাকে কোনো রকমের ছাড় দেয়া হবে না।
সেলিম ওসমানের এসকল বক্তব্য বিভিন্ন প্রশংসিত হলেও সাথে সাথে এসকল বক্তব্যকে কলঙ্কিত করে দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। শহর ও বন্দর যেন কোথাও কোনো পরিবর্তন আসেনি। সেই সাথে প্রশাসনেরও কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। হাম্মাজান-খান সাহেব-মাস্তান সদর্পেই শহরজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
অন্যদিকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর পবিত্র ওমরা হজ পালনের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার আগে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা চেয়ে সৌদি আরব যান। এরপর পবিত্র কাবা শরীফ ও মদিনাতে নবীজির রওজা শরীফের সামনে থেকে কয়েকবার ভিডিও বার্তায় দেশে ফিরে মাদক, সন্ত্রাস ও মাদক দূর করতে কাজ করার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন।
শামীম ওসমান বলেছিলেন, আমি বিনীত অনুরোধ করছি আপনারা যারা ভালো মানুষ আছেন দয়া করে যদি এগিয়ে আসেন। পুলিশের একার পক্ষে মাদক নির্মূল করা সম্ভব না। ভালো মানুষ এগিয়ে আসলে পঞ্চায়েত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুললে মাদক সন্ত্রাস চাঁদাবাজ বন্ধ করতে পারি। আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসেন এবার ফিরে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিবো। এ জন্য আমি সকলের সহযোগিতা চাই। কিন্তু দেশে ফেরার পর এর কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
এর আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের এক কুতুবপুরের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু বলেন, আমি কোন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের সাথে বসবো না এতে যদি আমাকে রাজনীতি ছেড়ে দিতে হয় আমি দিবো। আপনি যদি বলে আমি চেয়ারম্যানিও ছেড়ে দিব। তার পরও কোন সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীর সাথে আমি আপস করবো না। ওই সময়ে শামীম ওসমান মাইক হাতে তুলে নিয়ে বলেন, আমার পরিবারের কেউও যদি মাদক, চাঁদাবাজী করে কোন ছাড় দেওয়া হবে না। আমি তোমার সঙ্গে আছি।
এভাবে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমান বিভিন্ন সময়ে এসকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আসলেও কার্যত এর কোনো প্রমাণ দেখা যায় না। একদিকে তারা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন অন্যদিকে হোন্ডাবাহিনী সন্ত্রাসীরা তাদের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :