News Narayanganj
Bongosoft Ltd.
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৩, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩০

নৌকা ডুবিয়ে বিপাকে


দ্যা নিউজ নারায়ণগঞ্জ ডটকম | বিশেষ প্রতিনিধি : প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩, ১১:১৪ পিএম নৌকা ডুবিয়ে বিপাকে

৭ বছর আগে নৌকাকে ডুবিয়েছিলেন। এখন তারাই পুড়ছেন ক্ষোভের অনলে। আওয়ামীলীগের ঘাটি দাবি করা কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতারা বিগত দিনে নৌকা ডুবিয়ে বিপাকে পড়েছেন। দুই বছর আগে বিএনপি থেকে আওয়ামীলীগে যোগদান করিয়ে মনিরুল আলম সেন্টুকে নৌকার মাঝি করলেও এখন সেই নৌকায় উঠতে পারছেন না নিজেরাই। সেন্টুর বিরুদ্ধে জেলার শীর্ষ নেতাদের কাছে বিচার নিয়ে হাজির হলেও কোন সুরহা মিলছেনা।

জানা গেছে, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মনিরুল আলম সেন্টু। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মনিরুল আলম সেন্টু। ওই নির্বাচনেও আওয়ামীলীগের সমর্থিত প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। ওই সময় সেন্টুর বিপক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম পান্না মোল্লা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। আর আওয়ামীলীগের সমর্থিত প্রার্থী হয়েছিলেন তৃতীয়।

২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুকে তার পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মনিরুল আলম সেন্টু ফতুল্লা থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং তৎকালীন কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে নাশকতার একটি ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল ও গৃহীত হওয়ায় তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে এমপি শামীম ওসমানের সঙ্গে সখ্যতায় সেন্টুর সেই সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

এদিকে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক না নিয়ে স্বতন্ত্র প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন মনিরুল আলম সেন্টু। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল  দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি মনিরুল আলম সেন্টুকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এতে বলা হয়, বহিষ্কারের পর থেকে তিনি বিএনপির সঙ্গে যুক্ত নন। তিনি দলীয় কোনো কর্মকান্ডে অংশ নিতে পারবেন না। সেন্টু বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পর থেকে ধীরে ধীরে আওয়ামীলীগে ঘেঁষতে থাকেন। এমপি শামীম ওসমানকে ‘পীর’ হিসেবেই আখ্যায়িত করে বক্তব্য রাখেন। শামীম ওসমান সংসদ সদস্য হবার পর থেকে সেন্টু তার অনুগত হয়ে যান। দলের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও শামীম ওসমানের সকল নির্দেশনা পালন করতেন এই সেন্টু।

২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান (সম্প্রতি বিএনপি থেকে বহিস্কৃত) মনিরুল আলম সেন্টু ৪২ হাজার ৯০৩ ভোট পেয়ে আবারো চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের আওয়ামীলীগ প্রার্থী গোলাম রসুল শিকদার পেয়েছেন ১০ হাজার ৯৮৭ ভোট। সারাদেশে যেখানে নৌকার জয়জয়াকার ছিল সেখানে কুতুবপুরের চিত্র ছিল উল্টো। আওয়ামীলীগের এমপি শামীম ওসমানের আর্শিবাদে কুতুবপুরে আবারো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সেন্টু। অনেক আওয়ামীলীগ নেতা দলের সঙ্গে বেঈমানী করে চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুর পক্ষে কাজ করেন বলে অভিযোগ ছিল।

এদিকে সেন্টুর সঙ্গে যোগসাজশে নৌকা ডুবালেও বছর না ঘুরতেই মনিরুল আলম সেন্টুর সঙ্গে বিরোধ বেধে যায় কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি জসিমউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মানিক চাঁন সহ অন্যান্য আওয়ামীলীগ নেতাদের। বিশেষ করে আওয়ামীলীগ নেতাদের ভিজিএফ কার্ড না দেয়ায় বিরোধের সূত্রপাত। যে কারণে সেন্টু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের জুন মাসের শেষ দিকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আওয়ামীলীগ নেতাকর্মী ও তাদের সমর্থকরা। ভিজিএফ কার্ড বিতরণ নিয়ে অনিয়মের প্রতিবাদে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয়া কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন জানান, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে আনারস প্রতীকের প্রার্থী চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুর পক্ষে যারা কাজ করেছে তাদেরকেই এবার ভিজিএফ কার্ড প্রদান করেছেন সেন্টু। অপরদিকে যারা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন তাদেরকে এবার ভিজিএফ কার্ড দেননি সেন্টু। তিনি ভিজিএফ কার্ড নিয়ে রাজনীতি করেছেন। বিষয়টি আমি থানা ও জেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দদের জানিয়েছি। তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া না হলে আরো কঠোর আন্দোলন করা হবে।

তবে এব্যাপারে কুতুবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু সাংবাদিকদের বলেন, কার্ড বিতরণের অনিয়ম কিছুই হয়নি। যারা বিক্ষোভ করেছে তারা মাদক ব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসায়ী জসিমকে কার্ড দেইনি বলে আমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ওদের সৎ সাহস থাকলে আমার কাছে আসতো। ওরা ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তুলে খায়। আমিতো ১৫ বছর ধরে চেয়ারম্যানগিরি করি। আমি ওদেরকে ভালমতোই চিনি। 

এদিকে প্রশ্ন উঠেছিল কুতুবপুর ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য নেতারা যদি মাদক ব্যবসায়ী হয়ে থাকে তাহলে চেয়ারম্যান সেন্টু কেন এতদিন তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিবাদ করেননি। বরং উল্টো কেন তিনি সভাপতি জসিমউদ্দিনের সভাপতিত্বে মাদক বিরোধী শপথ নিয়েছেন। তখন যদি জসিমউদ্দিন মাদক ব্যবসায়ী না হয়ে থাকেন তাহলে এখন কেন সেন্টু তার বিরুদ্ধে বিষোদাগার করছেন। যদিও জসিম উদ্দিন চেয়ারম্যান সেন্টুর ফুফাতো ভাই বলে জানা গেছে।

২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানা বিএনপির সহ-সভাপতি ও কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুকে আবারো বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। নারায়ণগঞ্জ চার আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী এমপি শামীম ওসমানের পক্ষে নৌকায় ভোট চাওয়ার অভিযোগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আওয়ামী লীগ সদস্য সংগ্রহ শুরু করলে তিনি সদস্য ফরম পূরণ করে দলটির সদস্য পদ নেন।

২০২১ সালের ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মনিরুল আলম সেন্টু। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক বিএনপি নেতার হাতে তুলে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেলেও অনেকটা মুখ বুজেই সহ্য করতে হয়েছিল অনেককেই।

২০২২ সালের ২৩ জুন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পাগলা বাজার বহুমুখী ব্যবসায়ী সমিতির ২৫তম বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমপি শামীম ওসমান কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টুকে উদ্দেশ্য বলেন, সেন্টু আগে বিএনপি করতো, এখন আওয়ামী লীগ করে। এটি তার মাথায় রাখতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দিয়েছেন। সেন্টু নিজে আওয়ামী লীগ করবে আর তার লোকেরা বিএনপি করবে, এটা হবে না। সেন্টুকে বলবো- সব নিয়ে আসুন আওয়ামী লীগে, একসাথে কাজ করি।'

এদিকে ফতুল্লার কুতুবপুরের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপের সঙ্গে দেখা দেয় বিরোধ। তাঁরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। ২০১৬ সালে নৌকা ডুবানোর খেসারত যে তাদের এমনভাবে দিতে হবে সেটা তারা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেননি।

১২ সেপ্টেম্বর জনসভার সফল করতে ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের ব্যানারে প্রস্তুতি সভা করা হয়। সেখানে এমপি শামীম ওসমান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

প্রস্ততি সভায় বক্তব্য শেষে কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনিরুল আলম সেন্টুকে জয় বাংলার স্লোগান দিতে বলেন শামীম ওসমান।

তখন সেন্টু চেয়ারম্যান বলেন, আমি কোন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের সাথে বসবো না এতে যদি আমাকে রাজনীতি ছেড়ে দিতে হয় আমি দিবো। আপনি যদি বলে আমি চেয়ারম্যানিও ছেড়ে দিব। তার পরও কোন সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীর সাথে আমি আপস করবো না। কারণ আমার পারিবারিক একটি ঐতিহ্য আছে। আমি মাদক তো দূরের কথা একটি টাকা চাঁদাবাজী করি নাই। কিন্তু যে এক দুইজনের কারণে এলাকার হাজার হাজার মানুষ অশান্তি করবে তাদের সঙ্গে আমি চলতে পারবো না। আমি যখন বিএনপি করি তখন বিএনপির যারা অপরাধ করতো তাদের দৌড়ের উপর রাখতাম।

ওই সময়ে শামীম ওসমান মাইক হাতে তুলে নিয়ে বলেন, আমার পরিবারের কেউও যদি মাদক, চাঁদাবাজী করে কোন ছাড় দেওয়া হবে না। আমি তোমার সঙ্গে আছি।

ওই বক্তব্যে সেন্টু কারো নাম উল্লেখ না করলেও এর প্রতিক্রিয়া এসেছে সেখানকার বিতর্কিত নেতা মির হোসেন মিরুর কাছ থেকে যার বিরুদ্ধে রয়েছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী সহ অসংখ্য মামলা ও অভিযোগ। সমাবেশের পর সেন্টুর বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলনেরও ঘোষণা দেন মিরু।

এর দুইদিন পর ১৪ সেপ্টেম্বর কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রস্ততি সভায় ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি হাজী জসিম উদ্দিনের  সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মো. নাজিম উদ্দীন আহম্মেদ।

সেখানে মীরু বলেন, যারা আমার মা বোনকে পিটিয়েছে, আমার ভাই কে শরীরের কোন জায়গা বাদ নাই যে পিটিয়েছেন, তারাই নাকি ভালো আর আমি সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী হয়ে গেলাম।

কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেন্টুকে উদ্দেশ্যে করে মীরু বলেন, যখন নৌকার নির্বাচন করেছেন তখন চরমোনাই এর প্রার্থীর মনোনয়ন কে ছিনিয়ে এনেছিল, বাসদের মনোনয়নকে ছিনিয়ে এনেছিল ও তখন আমি ভালো ছিলাম এখন খারাপ হয়ে গেছি। আমাকে মারবেন মারেন আমি মরলে আপনি হবেন এক নাম্বার আসামী। ১৬ তারিখ জনসভার পর আপনার বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলন করবো। আমাদের সবাইকে অপমান করেছেন কারা আওয়ামী লীগের ভিতরে মাদক ব্যবসায়ী তাকে দেখাতে হবে না হলে আমরা এর জবাব চাইবো শামীম ওসমানের কাছে। তিনি কোন সমাধান না দিলে আমরা আওয়ামীলীগ থেকে পদত্যাগ করবো।

এদিকে সেন্টুর ওই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে গোটা কুতুবপুরের আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরাই। বিশেষ করে কর্মী সমাবেশে সেন্টুর এ ধরনের বক্তব্য আশা করেননি কেউই। বিগত দিনেও সেন্টুর পক্ষ নিয়ে নৌকা ডুবালেও পরবর্তীতে আওয়ামীলীগের অনেক নেতাকেই নিগৃহীত হতে হয়েছে। এখন সেন্টুর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সেই ছাই চাপা আগুনে যেন ঘি ঢেলেছে। যে কারণে এখন সেন্টুর বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে শীর্ষ নেতাদের কাছে নালিশ নিয়ে ধর্না দিচ্ছেন কুতুবপুর আওয়ামীলীগ নেতাদের অনেকেই।

Islams Group
Islam's Group