আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ-১ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন এলাকার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। বিশেষ করে নারায়গগঞ্জ-৫ তথা সদর বন্দর এলাকার মনোনয়ন প্রত্যাশীদের জন্য বেশিই চিন্তার কারণ। কারণ আগামী সংসদ নির্বাচনে নারায়গগঞ্জ-৫ আসনেই তার নির্বাচন করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সাথে তাকে নির্বাচন করার মতো সুযোগও দেয়া হতে পারে। তৈমূরের কারণে টেনশনে রয়েছেন আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অনেকেও।
সূত্র বলছে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের শুরুতেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সে হিসেবে দিন যাওয়ার সাথে সাথে ঘনিয়ে আসছে এই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা সরব হতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট এলাকাকে ঘিরে। তারই ধারাবাহিকতায় নারায়ণগঞ্জেও মনোনয়ন প্রত্যাশীরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।
তবে এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনও প্রস্তুত নয় বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। কেন্দ্রীয়ভাবেই তারা নিবাচনের থেকে বেশি মনযোগী আন্দোলন সংগ্রামের দিকে। বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। নির্বাচনী এলাকাকে ঘিরে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন আয়োজনকে কেন্দ্র করে নিজেদের সরব উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেছেন।
তারই অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন এলাকায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশায় আলোচনায় রয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাত।
সেই সাথে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের বর্তমান সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আলোচনায় রয়েছেন। আগামী সংসদ নির্বাচনেও তিনি নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সাথে নির্বাচনী এলাকায় তার যোগাযোগ বাড়িয়েছেন।
তাদের সাথে এবার নতুন করে যোগ হতে যাচ্ছেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। যিনি বিএনপির চেয়ারপার্সনের সাবেক উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি আর বিএনপিতে নেই। ইতোমধ্যে বিএনপি ছেড়ে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত নাজমুল হুদার প্রতিষ্ঠিত দল তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। সেই সাথে মহাসচিবও হয়েছেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার।
সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতে তৃণমূল বিএপির নির্বাচনে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তৃণমূল বিএনপি নির্বাচনে গেলে দলের মহাসচিব হিসেবে নারায়ণগঞ্জের একটি আসনে নির্বাচন করার সুযোগ পাবেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। আর এই আসনটির প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে নারায়ণগঞ্জ-৫ তথা সদর বন্দর এলাকা। সে হিসেবে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন এলাকার মনোনয়ন প্রত্যাশীদের জন্য চিন্তার কারণই বটে তৈমূর আলম খন্দকার।
এদিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিবারের মতো এবারও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনসহ পাঁচটি আসনেই নৌকা প্রতীকের দাবি জানিয়ে আসছেন। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা প্রায় সকলেই একমত নৌকা প্রতীকের দাবিতে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথেও তারা যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনটিতে তারা কোনোভাবেই ছাড় দিতে রাজি নয়।
আওয়ামী লীগের নেতাদের মতে, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনটি হচ্ছে জেলার হেডকোয়ার্টার। এখান থেকেই পুরো জেলার রাজনীতি পরিচালিত হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে অন্য দলের প্রার্থী থাকার কারণে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সাংগঠনিক ভিত্তি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এটা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্য দুঃখজনক কষ্টকর। নারায়ণগঞ্জ হচ্ছে আওয়ামী লীগের জন্মস্থান। সে নারায়ণগঞ্জের হেডকোয়ার্টারে অন্যদল রাজত্ব করে তাহলে নেতাকর্মীদের জন্য মেনে নেয়াটা কষ্টকর।
সেই লক্ষ্যে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে সরব রয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। তিনি বেশ জোরালোভাবেই নির্বাচনী মাঠে সরব রয়েছেন। বিভিন্ন সভা সমাবেশে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বর্তমান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যকে ইঙ্গিত করে নানাভাবে বক্তব্য দিয়ে আসছেন। সেই সাথে তিনি অনেকটাই নিশ্চিত আগামী দিনে তিনিই হয়তো নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পাবেন।
কিন্তু এরই মধ্যে যেন হিসেব নিকেশ উল্টে হয়ে যেতে শুরু করেছে। নির্বাচনী সমীকরণ মিলাতে গিয়ে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির বাইরে নতুন মুখ হিসেবে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগে, ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। বিএনপিতে থাকাকালীন দল তাকে প্রথমে ইঙ্গিত দিলেও পরবর্তীতে তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে নিষেধ করেন। কিন্তু এই নির্দেশনা না মেনেই তৈমূর নির্বাচনী মাঠে থেকে যান। সেই সাথে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য স্লোগান হয়েছে নারায়ণগঞ্জ শহরজুড়ে।
তবে নির্বাচনের ফলাফলে মাঠে ঠিকতে পারেনি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। একই সাথে নির্বাচনের দুইদিন পর অর্থাৎ ১৮ জানুয়ারি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) নির্বাচনে পরাজিত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
তবে সিটি কর্পোরেশনের এই নির্বাচনে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের জনপ্রিয়তার বিষয়টি বিএনপি অনুধাবন না করলেও আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান প্রধামমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিকই অনুধাবন করেছিলেন।
২০২২ সালের ৭ মে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সুনির্দিষ্ট ১২টি এজেন্ডার বাইরেও নানা ইস্যুতে টানা প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা বৈঠক চলে। সভায় ৬ জন সাংগঠনিক সম্পাদক নিজ নিজ বিভাগের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
সেখানে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ইভিএমে হয়েছে। সেখানে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী ছিল। মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়েছে। এ ভোট নিয়ে কোনো অভিযোগ কেউ করতে পারেনি। কাজেই আমি দেখতে চাই, দেশের মানুষের জন্য এত করলাম, দেশের মানুষ আমাকে কী দেয়? ইভিএমে ভোটে যাতে কোনো ধরনের অভিযোগ না থাকে। এজন্য দলীয় নেতাকর্মী এবং এমপিদের এলাকায় যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কর্মীবান্ধব হতে হবে।’
তার আগে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসংদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। কিন্তু তাকে বিএনপি দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়নি। প্রাথমিক বাছাইপর্বে রাখলেও চূড়ান্ত পর্যারে গিয়ে তৈমূর আলম খন্দকারকে রাখা হয়নি।
২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর গণভবনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখতে আসা দেশি বিদেশি পর্যবেক্ষক এবং বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে শেখ হাসিনা বিএনপির প্রার্থীতা বাছাই প্রসঙ্গে তৈমূর আলম খন্দকারের নাম উচ্চারণ করে নিজের মতামত জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, ‘যে বেশি টাকা দিতে পেরেছে সেই মনোনয়ন পেয়েছে এবং এ কারণে তারা তাদের অনেক জয়ী হওয়ার যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়নি। এমন অনেকেই মনোনয়ন পাননি। ‘আমি উদাহরণ দিয়ে দেখাতে পারি, ঢাকার ধামরাইয়ে জিয়াউর রহমান তাদের যোগ্য প্রার্থী ছিলেন, কিন্তু তিনি মনোনয়ন পাননি। নারায়ণগঞ্জের তৈমূর আলম তিনিও তাদের বিজয়ী প্রার্থী হতে পারতেন। তাঁকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। সিলেটে তাদের বিজয়ী হওয়ার মতো নেতা ইনাম আহমদ চৌধুরীকেও তারা মনোনয়ন দেয়নি।’
আপনার মতামত লিখুন :