নারায়ণগঞ্জ ছাড়িয়ে এবার সারাদেশে আলোচনায় তৈমূর আলম খন্দকার। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এ নেতা এবার যোগ দিয়েছেন তৃণমূল বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলে। অনেকেই মনে করছেন, এ দলটি বিএনপি ভাঙার কাজে লিপ্ত।
এক নজরে তৈমূর আলম খন্দকার
১৯৫৩ সালের ১৯ অক্টোবর শাহআলম খন্দকার ও রোকেয়া খন্দকারের পরিবারে জন্ম নেন তৈমুর। ইতোমধ্যে বাবা ও মা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ভাই বোনদের মধ্যে তৈমূর আলম খন্দকার সবার বড় ছেলে।
তৈমূরের বাবা শাহআলম খন্দকার ছিলেন বিলুপ্ত গ্রীন্ডলেজ ব্যাংক এর বাংলাদেশ ও নারায়ণগঞ্জ শাখার ম্যানেজার। ইস্ট পাকিস্তান গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন। শাহআলমের বাবা তোরাব আলী খন্দকার ছিলেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তির একজন।
নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় ফাস্ট ক্লাস পান তৈমূর। ৬৯ সালে তোলারাম কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হয়। এ কলেজে পড়াশোনা কালে সংগঠক হিসেবে নিজেকে জাহির করেন। মাসদাইরে প্রভাতী কল্যাণ সংস্থা, মুসলিম একাডেমী করার পাশাপাশি দিনমজুরদের বিভিন্ন সংগঠনও শুরু করেন। ঠেলাগাড়ি, ভ্যান গাড়ি, রিকশা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পক্ষে কাজ শুরু করেন তৈমূর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। ৭৪ সালে ডিগ্রী পরীক্ষায় সেকেন্ড ক্লাস পায়। পরে তৈমুর ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জ ল কলেজে। এ কলেজ থেকে ৭৬ সালে ল পাশ করে ৭৮ সালে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবি সমিতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৮২ সালে ঢাকার মগবাজার এলাকার হালিমা ফারজানার সঙ্গে বিয়ে হয় তৈমূর আলম খন্দকারের।
৮৪ সালে তৈমূর চলে যান ইংল্যান্ডে। সেখানে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে ব্যারিস্টার পড়াশোনা করে ৩পার্টের মধ্যে পার্ট ১ ও ২ শেষ করেন। ৮৫ সালে দাদা তোরাব আলী মাস্টার মারা গেলে তৈমূর দেশে ফিরে আসলে আর বিলেতে যাওয়া হয়নি।
তৈমূর আলম খন্দকারের ২ মেয়ে। বড় মেয়ে ব্যারিস্টার মার ই য়াম খন্দকার বিবাহিত। তিনি এখন বাবা তৈমূর আলম খন্দকারের সঙ্গেই কাজ করেন।
১৯৯৬ সালে তৈমূর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছা পোষন করলেও শামীম ওসমানের কারণে তা হয়ে ওঠেনি। পরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। ওই সময়ে শহরের চাষাঢ়ায় অবস্থিত শহীদ জিয়া হল মিলনায়তনের নাম পরিবর্তন করে মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তন করে আওয়ামী লীগ যার তীব্র বিরোধীতা করেন তৈমূর। একই সময়ে সাবেক এমপি আবুল কালাম নিস্ক্রিয় হলে তৈমূরকে সে সময়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সভাপতি পদ দেওয়া হয়। শহরের শায়েস্তা খান সড়কে তৈমুরের চেম্বার থাকলেও শামীম ওসমানের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে এক পর্যায়ে ১৯৯৭ সালে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে ঢাকায় থেকে হাইকোর্টে আইন পেশা চালিয়ে যান তিনি। ওই সময়ে একটি রাজনৈতিক মামলায় হাইকোট থেকে গ্রেপ্তার হয়ে রাজনীতিতে আলোচনায় ওঠে আসেন।
১৯৯৯ সালে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির একটি মিছিলে গুলি করে আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী। ওই মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। ঢাকায় অবস্থান করাকালীন ২০০১ সালের ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলা ঘটনায় তৈমূর আলমকে আসামী করা হয়।
২০০১ সালের নির্বাচনে দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি-জামাত জোট সরকার তৈমূর আলম খন্দকারকে বিআরটিসির চেয়ারম্যান বানায়। এর আগে তিনি ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
২০০৩ সালে তৈমূরকে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ২০০৭ সালে ওয়ান এলেভেনের পর বিএনপির বর্তমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হলে প্রথমবারের মত তার আইনজীবি হিসেবে আইনী লড়াই চালিয়েযান তৈমুর। পরে ওই বছরের ১৮ এপ্রিল যৌথবাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে ৮টি মামলা করে যার মধ্যে একটি মামলায় ১২ বছরের জেল হয়।
২০০৯ সালের মে মাসে মুক্তি পান তৈমুর। ওই বছরের জুন মাসে তৈমুরকে আহবায়ক করে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। বছরের শেষের দিকে ২৫ নভেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে তৈমুর হন জেলা বিএনপির সভাপতি। একই সঙ্গে তাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ আইন বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা ১৮দলীয় ঐক্য জোটের আহবায়ক করা হয়। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন তৈমুর। বিএনপি প্রথম দিকে তাকে সমর্থন দিলেও ভোটের মাত্র ৭ ঘণ্টা আগে দলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে তিনি নির্বাচন থেকে সরে আসেন।
২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। আর এই বিষয়টিকে কেন্দ্রীয় বিএনপি সহজভাবে নিতে পারেনি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর দাপুটে জয়ে পরাভূত হয়েছেন স্বতস্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। ১৯২ কেন্দ্রের সবগুলোর ফলাফলে নৌকা পেয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট। আর হাতি প্রতীকে তৈমূর পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের অংশ নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হলেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার ও এটিএম কামাল। দলের সকল পদ থেকে দুইজনকে বহিস্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে তৈমূর আলম খন্দকারকে এর আগেই বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির আহবায়কের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। ১৬ জানুয়ারী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের শুরুতে তৈমূরের সঙ্গ দিলেও এটিএম কামালকে ভোটের দুইদিন পর বহিস্কার করা হলো। ১৮ জানুয়ারী দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত পৃথক চিঠিতে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়া হয়।
আপনার মতামত লিখুন :