ওয়ান এলেভেনের পর যখন দেশে এক সঙ্কটকাল তখন বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হলে আদালতে প্রথম আইনজীবী হিসেবে মামলা লড়ে তখনকার সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রোষানলে পড়েন তৈমূর আলম খন্দকার। পরবর্তীতে তৈমূরকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিলে ক্রসফায়ারের হুমকি দিলেও বেঈমানী করেননি তৈমূর যিনি বিএনপি সরকারের আমলে সুপ্রীম কোর্টের ডেপুটি এটর্নি জেনারেল ও বিআরটিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যদিও এর আগে থেকেই এ নামটি নারায়ণগঞ্জে বেশ আলোচিত। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গুলি থেকে রক্ষা পাওয়া এ নেতাকে ২০১১ সালে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ভোট গ্রহণের মাত্র ৭ ঘণ্টা আগেই সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে যাকে তিনি আখ্যা দেন ‘গোছল ছাড়া কোরবানী’। ২০২২ সালের নির্বাচনেও দলের বিরুদ্ধে অবস্থান করায় বিএনপি তাকে বহিস্কার করে। চিঠি দেওয়ার পরেও দেড় বছরে উঠেনি বহিস্কারাদেশ। কিন্তু তার পরেও ছিলেন জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক বিএনপির কয়েকটি সভা সমাবেশে তিনি বিএনপির পতাকা নিয়ে হাজির হন পেছনে ছিলেন হাজারো নেতাকর্মী। এরই মধ্যে কৃষক দলে দুই ভাগ্নে সহ অনুগামীদের জায়গা হওয়া ও কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে ছোট ভাই কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদকে মূল্যায়ন করে তারেক রহমান পল্টন অফিসে ডেকে নিয়ে স্কাইপেতে কথা বলার পর পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ফের যখন রাজনীতির মাঠে তৈমূর পরিবার তখনই জানা গেল এক দুঃসংবাদের কথা। কারণ এ তৈমূরকে নিয়ে গঠিত হতে যাচ্ছে বিএনপি নেতা প্রয়াত নাজমুল হুদা প্রতিষ্ঠিত ‘তৃণমূল বিএনপি’। ১৯ সেপ্টেম্বর তাদের প্রথম কাউন্সিল হবে। সেদিন দলটিতে যোগ দেবেন রাজনৈতিক অঙ্গনে আগে থেকে পরিচিত ও আলোচিত মুখ শমসের মবিন চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দলত্যাগের মধ্য দিয়ে তৈমূরের এক সাহসী রাজনৈতিক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবারের যারা রাজনীতিতে জড়িত তাদের সামনেও থাকবে এক ভয়াবহ অন্ধকার পথচলা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, একটি রাজনৈতিক মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তৃণমূল বিএনপির প্রথম কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নামের সঙ্গে মিল থাকা তৃণমূল বিএনপিতে নতুন চমক থাকছে। দলটির শীর্ষ দুই পদে (চেয়ারম্যান ও মহাসচিব) আসতে যাচ্ছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য (বহিষ্কৃত) এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক তৈমুর আলম খন্দকার। শুধু তারা নয়, পর্যায়ক্রমে বিএনপি থেকে বিভিন্ন সময় বাদ পড়া এবং নিজ থেকে ছেড়ে দেওয়া নেতারাও এ দলে যোগ দেবেন। সেই তালিকায় বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা ব্রাহ্মণবাড়িয়াা-২ আসনের সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তারও আছেন।
এ প্রসঙ্গে তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘আমি তো আর আওয়ামী লীগে যোগ দেব না। সারা বছর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি করে আসছি। আর বিএনপি আমাকে গত দেড় বছর ধরে বহিষ্কার করে রেখেছে। আমি তো আর দল ছাড়িনি। একজন বহিষ্কৃত লোক কত বছর একটা পতাকা টেনে নিতে পারে? এখন আমার পরিচয় কী? মারা গেলে আমার পরিচয় কী হবে? কোন ব্যানারে আমি বক্তব্য দেব। আমার জন্ম তো রাজপথে। যেহেতু বিএনপি আমাকে বহিষ্কার করেছে, সেহেতু আমাকে এখন তৃণমূল বিএনপিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। আমি সেখানেই যাচ্ছি।
এদিকে তৈমূরের এ দলত্যাগের কারণ বিপাকে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা। ছোট ভাই মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের চার বারের নির্বাচত কাউন্সিলর। ২০০৩ সালে শুরু পৌরসভার নির্বাচন দিয়ে। এর পর আর তাকে পেছনে ফিরতে হয়নি। পরের ২০১১, ২০১৬ ও সবশেষ ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারী নির্বাচনে তিনি সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে খোরশেদ এখন সারাদেশে একটি আলোচিত নামে পরিণত। করোনার ভয়াবহতা বাড়তে শুরু করলে দাফন, সৎকার থেকে শুরু করে সবকিছুতেই এগিয়ে ছিলেন খোরশেদ। তখন থেকেই তিনি রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে থাকেন। প্রচারণা করেন ব্যক্তি খোরশেদের। আর অল্পদিনেই বনে যান ‘করোনা হিরো’ আর ‘করোনা বীর’ সহ নানা উপাধিতে। খোরশেদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৪৯টি। বিগত দিনে হরতাল অবরোধ চলাকালে সামনের সারিতে থাকা এ যুবদল নেতাকে এখন পর্যন্ত কারাবন্দী হতে হয়েছে ১০ বারের মত। এছাড়া জেল গেট থেকেও গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেকবার। মহানগর যুবদলের সেক্রেটারী থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন কালে খোদ প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিরাও তাঁর সক্রিয়তাকে স্বীকার করেছেন।
তৈমূরের ভাগ্ন রাশিদুর রহমান রশো এক সময়ে ছাত্রদলের ডাকসাইটে নেতা ছিলেন। ৯৫ সালে নারায়ণগঞ্জ কলেজ শাখার যুগ্ম আহবায়ক ও পরে সভাপতি হন। ওই সময়ে নারায়ণগঞ্জ থানা ছাত্র দলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক, পরে তিনি মহানগরের যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে মহানগর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ইতোমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা চলমান রয়েছে। কারাভোগ করেছেন ৯ বার। ২০১৪ সালের গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ ৮ মাস কারাবন্দী ছিলেন রশু। এরপর নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন থানার মামলায় টানা চারবার জেলগেট থেকে গ্রেফতার এবং অনেকবার রিমান্ডে গিয়েছেন। বর্তমানে তিনি কৃষক দলের মহানগরের সাধারণ সম্পাদক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৃণমূল বিএনপির একজন নেতা বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বে নতুন মুখ আনা হচ্ছে। যারা এক সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও তৃণমূল বিএনপি অংশ নেবে। তখন বিএনপিতে যারা নির্বাচন করতে আগ্রহী থাকবেন তারা এ দলে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন।
সবশেষ তৈমূল আলোচনায় এসেছিলেন গত এপ্রিল। তখন প্রায় ১০ মাস পর বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। গত ২২ এপ্রিল ঈদুল ফিতরের রাতে গুলশানের বাসায় বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করতে যান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির আট সদস্য। রাত ৮টা থেকে এক ঘণ্টার কিছুটা বেশি সময় তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করেন। আর ওই সময়ে কারাগারে আটক দলের নেতাকর্মীদের বিষয়েও জানতে চাওয়ার পাশাপাশি বিএনপির বহিস্কৃত নেতাদের ব্যাপারেও খোঁজ খবর নেন বেগম খালেদা জিয়া। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া বলেন, আমার তৈমূর কই? তাকে কেন বহিস্কার করা হলো? কার কাছে জিজ্ঞাসা করে তাকে বহিস্কার করা হয়েছে? বিএনপিতে তার কোনো অবদান ছিলো না? কেন তাকে বহিস্কার করা হলো?
আর এই খবর বিএনপি নেতাদের মাঝে প্রচার হওয়ার সাথে সাথেই বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের দারস্থ হতে থাকেন। সবাই তৈমূরের কাছে ভীড় করতে থাকেন। বিএনপির নেতাদের মাঝে ফের তার কদর বেড়ে যায়। শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে তৈমূরের সাথে দেখা করে বিভিন্ন সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
জেলা বিএনপির গতি ফেরাতে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির ৪১ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটির ঘোষণা দেন। আর এতে আহবায়ককরা হয় অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে এবং সদস্য সচিব করা হয় অধ্যাপক মামুন মাহমুদকে। আর এই কমিটি ঘোষণার আগে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে চলে নানা হিসেব নিকেষ। সকল হিসেব নিকেষ মিলিয়ে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের উপরই জেলা বিএনপির দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। কমিটি ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জ বিএনপির নেতাকর্মীরা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে দিয়ে দলীয় কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের সমাগম ঘটাতে থাকে। প্রায় প্রত্যেকটি কর্মসূচি নেতাকর্মীদের দ্বারা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। নেতাকর্মীরা ফিরে পান মনোবল। যেন এমন নেতৃত্বের অপেক্ষাতেই ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। প্রত্যেক কর্মসূচিতেই নজরকাড়া শোডাউন চলে জেলা বিএনপির।
এরই মধ্যে ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ায়ী অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার মেয়র প্রার্থী হন। দল তাকে প্রথমে ইঙ্গিত দিলেও পরবর্তীতে তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে নিষেধ করেন। কিন্তু এই নির্দেশনা না মেনেই তৈমূর নির্বাচনী মাঠে থেকে যান। সেই সাথে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য স্লোগান হয়েছে নারায়ণগঞ্জ শহরজুড়ে। তারপরেও দল এসকল বিষয় গুরুত্ব না দিয়েই নির্বাচন শেষে তৈমূরকে দল থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচনের দুইদিন পর অর্থ্যাৎ ১৮ জানুয়ারি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) নির্বাচনে পরাজিত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে বিএনপি থেকে বহিস্কার করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সুষ্পষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির গঠনতন্ত্র মোতাবেক আপনাকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে নির্দেশক্রমে বহিস্কার করা হলো।
আপনার মতামত লিখুন :