চলছে ডেঙ্গু সিজন। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। রোগী দেখতে খানপুর হাসপাতালে যাবেন গৃহবধূ তাসমিয়া। এক কেজি আপেল, এক কেজি মাল্টা ও দুইটি বড় আনারস কিনতে রিকশা থামালেন ২নং রেলগেইট এলাকায়। ট্রাফিক বক্সের সামনে ফলের দোকানে দাঁড়ালেন। আপেল ও মাল্টার দাম শুনেই তার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। এক কেজি ইন্ডিয়ান আপেল তিনশ টাকা। গৃহবধূ তাসমিয়া ভেবেছিলেন পাঁচশত টাকায় অনেক ফল কিনতে পারবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক কেজি আপেল ও দুইটি আনারস কিনতেই পাঁচশত টাকা শেষ। তিনি আফসোস করে বললেন, মানুষ কি খাবে। সবকিছুরই বাড়তি দাম। আপেল-আঙ্গুর মিষ্টি দামে টক!
এদিকে, ডলার সংকটের কারণে নারায়ণগঞ্জে সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে বিদেশি ফলের বাজার। ক্রমাগত দাম বৃদ্ধির কারণে আপেল, কমলা-মাল্টা ও আঙুর এখন কেবল ধনীদের ফলে পরিণত হয়েছে। সাধারণ ক্রেতারা উচ্চ দামে এসব ফল কিনতে পারছেন না। গত এক বছরের ব্যবধানে আপেল, কমলা-মাল্টাসহ প্রায় সব ফলের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। ডলার সংকটের কারণে বিদেশি ফল আমদানিতে আগের ৩ শতাংশের সাথে নতুন করে আরো ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করে সরকার। এরপর থেকে ফলের বাজার লাগামহীন হয়ে পড়ে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধুমাত্র ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বাড়ানোকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীরা আমদানির মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ দামে ফল বিক্রি করছেন। বিষয়টি সরকারের কোনো দায়িত্বশীল সংস্থা নজরদারি করছে না। তাই ফলের বাজারে অরাজকতা দেখা দিয়েছে।
গতকাল নগরীর কয়েকটি পয়েন্টে ফলের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি মাঝারি মানের চীনা আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকায়। এছাড়া ভারতের কাশ্মীরি আপেল বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। দক্ষিণ আফ্রিকার কমলা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা, মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ টাকা, ভারতীয় ডালিম বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ থেকে ৩৮০ টাকা, চীনা লাল আঙুর ৪২০ টাকা, সাদা আঙুর ৩৫০ টাকা, চীনা নাসপতি ২৪০ টাকা, দেশি ড্রাগন ৩২০ টাকা এবং রাজশাহীর দেশি মাল্টার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।
নগরীর ২নং রেলগেইট, ফলপট্টি ও দ্বিগুবাবুবাজারের খুচরা বিক্রেতা আজিজুল, ইয়াছিন বেপারী ও সাইফুল ইসলাম বলেন, পাইকারিতে দীর্ঘদিন ধরে ফলের বাজার চাঙা রয়েছে। আমদানিকারকরা আমাদের জানিয়েছেন, সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়েছে, তাই আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। আমরা পাইকারি থেকে অল্প অল্প ফল এনে বিক্রি করি। আবার পাইকারি বাজার থেকে পণ্য কেনার পর দেখা যাচ্ছে অনেক ফল পচা কিংবা মান খারাপ। তখন সেগুলো বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়।
এম এম ইলিয়াছ উদ্দিন নামের একজন ক্রেতা বলেন, এক কেজি আপেল কিনতে চেয়েছি। কিন্তু একেক দোকানে একেক রকম দাম হাঁকছে। শেষ পর্যন্ত আর কেনা হয়নি।
ভ্যানগাড়িতে করে দাগি আপেল বিক্রি করেন নোয়াব আলী। তিনি দ্বিগুবাবু বাজারের ফলের আড়তে ঘুরছেন। আপেল দরদামে মিলছে না। কারণ তিনি একটু দাগি মাল নিয়ে ঘুরে ঘুরে মহল্লায় বিক্রি করেন। দুই’শ টাকা দিয়ে মহল্লার লোকজন দাগি আপেল কিনবেন না। নোয়াব আলী তাই কলা কিনলেন।
নগরীর দ্বিগুবাবুর বাজারে ফলের আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়। এছাড়া প্রতি কেজি কমলা ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা, আপেল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, ডালিম ২৫০ থেকে ৩২০ টাকা, আঙুর ২৮০ থেকে ৩৪০ টাকা এবং নাসপতি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। পাইকারি বাজারের সাথে খুচরা বাজারে কোনো কোনো ফলের দামের পার্থক্য কেজিতে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা পর্যন্ত।
জানা গেছে, আমাদের দেশে মৌসুমভেদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আপেল-মাল্টার মতো বিদেশি ফল আমদানি হতো। বিশেষ করে আপেল আমদানি হতো চীন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। তবে আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও ভারত থেকে আপেল আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া মাল্টা আসতো মিসর ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। বাজারে এখন রয়েছে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার মাল্টা। এছাড়া আঙুর ও ডালিম চীন ও মিসর থেকে আসতো। তবে বাজারে এখন ভারতীয় ডালিম ও আঙুরের আধিক্য রয়েছে।
নগরীর দ্বিগুবাবু বাজারের ফলপট্টির কয়েকজন ব্যবসায়ী বলছেন, এক সময় ১০ শতাংশ মার্জিনে ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খুলে ফল আমদানি করা যেত। এখন শতভাগ মার্জিন দেয়ার পরেও অনেক ব্যাংক ডলার সংকটের কথা বলে এলসি দিচ্ছে না। এছাড়া ফল পচনশীল পণ্য। সঠিক সময়ে খালাস করতে না পারলে গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। তখন আর দাম পাওয়া যায় না। তাই অনেক ব্যবসায়ী ঝুঁকি নিয়ে আমদানি করছেন না। এতে বাজারে সরবরাহেরও সংকট রয়েছে। তাই বাজার চড়া।
আপনার মতামত লিখুন :