দীর্ঘদিন পর নারায়ণগঞ্জ বিএনপির রাজনীতিতে ফিরেছেন একসময়ের প্রভাবশালী নেতা বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের পরিবারের সদস্যরা। বিভিন্ন সময়ে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসলেও বর্তমানে তৈমূর সহ তার পরিবারের সদস্যরা বিএনপির রাজনীতি থেকে বিতাড়িত অবস্থায় ছিলেন। বিশেষ করে দলের কঠিন সময়ে তৈমূর সহ তার পরিবারের সক্রিয় অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু অনেকদিন ধরেই তারা বিএনপির রাজনীতিতে মূল্যায়িত হচ্ছিলেন না।
এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জ মহানগর কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক পদে রশিদুর রহমান রশু মনোনীত হয়েছেন যিনি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের আপন ভাগিনা। একসময় তিনি ছাত্রদল এবং যুবদলে দায়িত্ব পালন করেছেন। রশুর সাথে সাথে আরও কয়েকজন কৃষকদলে পদ পেয়েছেন। তারাও তৈমূর পরিবারের সদস্য ও তৈমূর বলয়ের রাজনীতি করে আসছেন। তাদের ফিরে আসার মধ্য দিয়ে তৈমূর পরিবারের সদস্যরা আবারও জেগে উঠবেন।
জানা যায়, মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিন ও সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে নারায়ণগঞ্জ মহানগর কৃষকদলের ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়।
কমিটিতে পদ পাওয়া নেতাদের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক রশিদুর রহমান রশু, সিনিয়র সহ-সভাপতি নাজমুল কবির নাহিদ, সহ সভাপতি মাহবুব হাসান জুলহাস, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদদক সাইফুদ্দিন মাহমুদ ফয়সাল, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আল-আমিন খান ও দফতর সম্পাদক শওকত খন্দকার তৈমূর পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচিত। অতীতে তারা তৈমূরের সূত্র ধরেই বিএনপির বিভিন্ন সহযোগি সংগঠনের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘদিন তারা আবারও পদে ফিরতে শুরু করেছেন।
এর আগে গত ২৯ মে অনেকটা অবাক করে দিয়েই নারায়ণগঞ্জ মহানগর কৃষক দলের ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিলো। যেখানে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রশিদুর রহমান রশু জায়গা করে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কমিটি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুধুমাত্র তৈমূর পরিবারের সম্পৃক্ততার কারণেই সেই কমিটি স্থগিত করা হয়। কিন্তু এবার সেই পূর্বের কমিটির সাথে তৈমূর পরিবারের আরও কয়েকজকে সংযুক্ত করে নতুন করে কমিটি ঘোষণা হয়েছে। যার মাধ্যমে তৈমূর পরিবারের সদস্যরা শক্তিশালী অবস্থান নিয়েই ফিরতে শুরু করেছেন।
দলীয় সূত্র বলছে, ২০০৩ সালে তৈমুরকে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ২০০৭ সালে ওয়ান এলেভেনের পর বিএনপির বর্তমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হলে প্রথমবারের মত তার আইনজীবি হিসেবে আইনী লড়াই চালিয়ে যান তৈমুর। পরে ওই বছরের ১৮ এপ্রিল যৌথবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে ৮টি মামলা করে যার মধ্যে একটি মামলায় ১২ বছরের জেল হয়। ২০০৯ সালের মে মাসে মুক্তি পান তৈমুর। ওই বছরের জুন মাসে তৈমুরকে আহবায়ক করে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। বছরের শেষের দিকে ২৫ নভেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে তৈমুর হন জেলা বিএনপির সভাপতি। একই সঙ্গে তাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ আইন বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা ১৮দলীয় ঐক্য জোটের আহবায়ক করা হয়।
এরপর ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন তৈমুর। বিএনপি প্রথম দিকে তাকে সমর্থন দিলেও ভোটের মাত্র ৭ ঘণ্টা আগে দলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে তিনি নির্বাচন থেকে সরে আসেন। ওই সময়ে অনেকেরই মন্তব্য ছিল অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে গোসল ছাড়াই কোরবানী দেওয়া হয়েছে। পরে তৈমূরকে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি থেকে সরিয়ে বিএপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা করা হয়।
তবে তৈমূর ছাড়া নারায়ণগঞ্জ বিএনপির রাজনীতি গতি হারিয়ে ফেলে। দলীয় কর্মসূচিতে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি ঘরকুনো হয়ে পড়ে। রাজপথে নারায়ণগঞ্জ বিএনপির দেখা মিলতো না।
পরবর্তীতে জেলা বিএনপির গতি ফেরাতে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির ৪১ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটির ঘোষণা দেন। আর এতে আহবায়ককরা হয় অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে এবং সদস্য সচিব করা হয় অধ্যাপক মামুন মাহমুদকে। সকল হিসেব নিকেষ মিলিয়ে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের উপরই জেলা বিএনপির দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়।
অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটি ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জ বিএনপির নেতাকর্মীরা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে দিয়ে দলীয় কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের সমাগম ঘটাতে থাকে। প্রায় প্রত্যেকটি কর্মসূচি নেতাকর্মীদের দ্বারা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। নেতাকর্মীরা ফিরে পান মনোবল। যেন এমন নেতৃত্বের অপেক্ষাতেই ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। প্রত্যেক কর্মসূচিতেই নজরকাড়া শোডাউন চলে জেলা বিএনপির।
এরই মধ্যে ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ায়ী অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার মেয়র প্রার্থী হন। দল তাকে প্রথমে ইঙ্গিত দিলেও পরবর্তীতে তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে নিষেধ করেন। কিন্তু এই নির্দেশনা না মেনেই তৈমূর নির্বাচনী মাঠে থেকে যান। সেই সাথে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য স্লোগান হয়েছে নারায়ণগঞ্জ শহরজুড়ে। তারপরেও দল এসকল বিষয় গুরুত্ব না দিয়েই নির্বাচন শেষে তৈমূরকে দল থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচনের দুইদিন পর অর্থ্যাৎ ১৮ জানুয়ারি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) নির্বাচনে পরাজিত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে বিএনপি থেকে বহিস্কার করা হয়।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি ও একসময়ের রাজপথ কাঁপানো নেতা ছিলেন মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। কিন্তু ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম নীরব এবং সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত করে দেন। পরে কমিটিতে আর জায়গা দেয়া হয়নি খোরশেদকে। সেই সাথে মহানগর বিএনপির কমিটিতেও তার জায়গা হয়নি।
অন্যদিকে ৯৫ সালে নারায়ণগঞ্জ কলেজ শাখার যুগ্ম আহবায়ক ও পরে সভাপতি হন রশিদুর রহমান রশু। ওই সময়ে নারায়ণগঞ্জ থানা ছাত্র দলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক, পরে তিনি মহানগরের যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে মহানগর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ইতোমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা চলমান রয়েছে। কারাভোগ করেছেন ১২ থেকে ১৫ বার। ২০১৪ সালের গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ ৮ মাস কারাবন্দী ছিলেন রশু। একই সাথে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন থানার মামলায় টানা চারবার জেলগেট থেকে গ্রেফতার এবং অনেকবার রিমান্ডে গিয়েছেন।
কিন্তু মহানগর যুবদলের নতুন কমিটিতে রশিদুর রহমান রশুর জায়গা হয়নি। মহানগর বিএনপির কমিটিতেও কোনো পদেই জায়গা হয়নি তার। এভাবে একের পর কমিটির মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জ রাজনীতিতে পদ-পদবী হারা হয়ে পড়েন তৈমূর পরিবারের সদস্যরা। অনেকদিন ধরেই তাদের কোনো পদ-পদবী ছিলো না। তবে পদ-পদবী না থাকলেও তৈমূর পরিবারের সদস্যরা বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সেই সাথে এবার রশিদুর রহমান রশু সহ অন্যদের পদায়িত করার মধ্য দিয়ে তৈমূর পরিবারের সদস্যরা মূল্যায়নে ফিরছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আপনার মতামত লিখুন :