নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন এমপি শামীম ওসমান যাঁদের মধ্যে সরাসরি ভোটের যুদ্ধ হয়েছিল ২০১১ সালের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে শামীম ওসমান প্রায় এক লাখেরও বেশী ভোটে পরাজিত হন। তবে শামীম ওসমানের মন্তব্য ‘নিজেকে নিজে কোরবানী দিয়েছি দলের স্বার্থে।’ আর সবশেষ ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারীর নির্বাচনে আইভীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে হাতি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচনে পরাজিত বিএনপির সাবেক নেতা তৈমূর আলম খন্দকার ফলাফলের পর থেকেই অভিযোগ করে আসছিলেন কারচুপি করে তাকে পরাজিত করা হয়েছে। আর এতে ব্যবহার করা হয়েছে ইভিএম মেশিন। এ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কথা না বললেও হঠাৎ করেই ১২ সেপ্টেম্বর মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ভয়াবহ এক তথ্য দেন। আর এটা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা সমীকরণ ও আলোচনা।
১৬ সেপ্টেম্বর ঘোষিত জনসভাকে ঘিরে শহরের চাষাঢ়ায় রাইফেল ক্লাবে আয়োজিত ওই সভায় শামীম ওসমান বলেন, ভোটের সময়ে বলবেন ভাই তখন বলবেন ভেদাভেদ নাই। নির্বাচনের পর সব ভুলে যাবেন। কে কেমনে কোথায় পাশ করেছেন সব জানি। যেদিন রাজনীতি ছেড়ে দিব সেদিন সব বলবো।
২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারীর নির্বাচনে শুরু থেকেই নারায়ণগঞ্জ আসেন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বহর। এতে দলের কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম এমপি, আবদুর রহমান থেকে শুরু করে শক্তিশালী বলয়ের নেতারা ছিলেন। এছাড়া প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ এসে কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনের কাজকে মনিটরিং করতেন। এছাড়া সহযোগি সকল সংগঠনের নেতারাও ছিলেন প্রচারণায়। মাঝেমধ্যে জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজমকে দেখা গেছে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়েও।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শামীম ওসমান চুপ থাকলেও ভোটের মাত্র ৬দিন আগে ১০ জানুয়ারী সংবাদ সম্মেলন করে দলের নেতাদের নৌকার জন্য কাজ করার আহবান রাখেন। এবং নৌকা জিতবে এটাও নিশ্চিত করেন। যদিও ওই সময়ে নৌকার পক্ষে কাজ না করার অভিযোগে মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ও তৎকালীন সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদের বাসায় ডিবির অভিযান চলে। এছাড়া ভোটের সময়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগের কমিটি বাতিল করা হয়।
জাহাঙ্গীর নানক পরোক্ষভাবেও হুঁশিয়ার দিয়ে বক্তব্য রাখেন যে যারা নৌকার পক্ষে কাজ করছেন না আগামী নির্বাচনে কিভাবে মনোনয়ন পাবেন সেটাও দেখে নেওয়া হবে।
শামীম ওসমান বলেন, ‘নির্বাচনের সময়ে বলবেন ভাই। পরে সব ভুলে যাবেন। নারায়ণগঞ্জে বহু বড় বড় নেতা আছেন। যাদের নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ১৪০ জন নেতা ছুটে এসেছিলেন। সকল সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা নামলেন, আমারও নামলাম। রেজাল্ট কি হয়েছে সেটা পরের বিষয়। কিন্তু নির্বাচনের পর বলবেন দলমতের ঊর্ধ্বে এসে কাজ করবেন আমি বলবো ‘সরি সরি সরি’। আপনি যখন প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন তখন দল মতের ঊর্ধ্বে গিয়ে কাজ করতে পারেন না। আপনাকে নিজের দলকে ধারণ করতে হবে।’
তিনি বলেন, আমি আওয়ামী লীগের একজন এমপি। আমার ভুল হলে সেটা দলকে জানাতে হবে। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। তারাও কোন ভুল অপরাধ করলে সেটা জায়গামত বলতে হবে।
এর আগেরদিন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে বাজেট অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তর পর্বে এমপি শামীম ওসমানকে কড়া ভাষায় তিরস্কার করেন আইভী। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারী হকার ইস্যুর ঘটনা স্মরণ করিয়ে ওই হামলার জন্য শামীম ওসমানকে দায়ী করে বলেন, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য উনি প্রকাশ্যে যেভাবে হকারদের অর্ডার দেন ফুটপাতে হকাররা বসবেই। প্রেস ক্লাব অসহায় কিনা আমি তা জানি না। কিন্তু আমি অসহায়। কারণ আমি আমার নিজস্ব লোকদের নিয়ে মাইরের শিকার হয়েছি। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি আমাকে পিটিয়েছিল, রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছিল। এদিন অল্পের জন্য আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। তারপরও আমি থেমে নাই।
এছাড়া আইভী নারায়ণগঞ্জ শহরের যানজট ও অটো রিকশার দৌরাত্ম্যের পেছনে প্রশাসনের নির্লিপ্ততার অভিযোগ তুলেন। এমপি ও তাদের লোকজনদের স্টিকারযুক্ত অটো শহরে সয়লাব হলেও প্রশাসন মেয়রের কথায় কোন কান না দিয়ে দুইজন এমপির কথায় উঠবস করেন অভিযোগ তুলেন।
শামীম ওসমান বলেন, ‘একটা অনুষ্ঠান হলো। সেখানে পলিটিক্যাল বক্তব্য দেওয়ার কথা না। কিন্তু বলে দিল। অথচ আমি প্রকাশ্যে রাস্তায় নামার আহবান রেখেছিলাম। মেসেজ দিয়েছিলাম। যখন আমরা কথা বলবো জামায়াত বিএনপির বিরুদ্ধে। তখন আমার বিরুদ্ধে কথা বলা হলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন আসলেন না, বাহাউদ্দিন নাসিমের সময়েও আসলেন না। অথচ যারা শহীদ মিনারে ১০-১২ জন মিলে বলেন প্রধানমন্ত্রীর বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে হবে তাদের সঙ্গে আবার আগের দিন ঠিকই মিটিং করলেন। নির্বাচনের আগে হঠাৎ ট্যাক্স বাড়িয়ে দিলেন। বলেন ওষুধে মশা মরে না তাহলে ভালো ওষুধ কিনেন।’
এখানে উল্লেখ্য ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারী হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূরকে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মত হ্যাট্রিট মেয়র ও চতুর্থবারের মত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী। ১৯২ কেন্দ্রের সবগুলোর ফলাফলে নৌকা পেয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট। আর হাতি প্রতীকে তৈমূর পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। এর আগে ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে ৬৫ শতাংশ পেয়ে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমান পান ২৮ শতাংশ ভোট। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে আইভীকেই। সেবার তিনি ১ লাখ ৭৪ হাজার ৬০২ ভোট পেয়ে পুননির্বাচিত হন। বিএনপির প্রার্থী আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচনে অংশ নিয়ে পান ৯৬ হাজার ৭০০ ভোট।
তবে পরের দুটি নির্বাচনে সাখাওয়াত ও তৈমূর প্রসঙ্গে বার বার আইভীর অভিযোগ ছিল তাঁরা শামীম ওসমানের প্রার্থী। তৈমূরকে নিয়ে বার বার এ উক্তি করেন আইভী। যদিও তৈমূরের ছিল সাফ জবাব, ‘আমি কারো পায়ের উপর ভর করে শহরে চলি না।’
এদিকে নির্বাচনে পরাজয়ের পর তৈমূর নানা অভিযোগ তুলেন। তিনি সবশেষ ১২ সেপ্টেম্বর বলেন, নির্বাচনে একটি প্রশাসনিক ক্যু হয়েছে। ভোটের দিন জেলা প্রশাসককে বদলী করা হয়েছে। সেই আদেশের কপি আমি মার্কিন দূতাবাসে জমা দিয়েছি। নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া গাড়ির নাম্বার, কাজগপত্র ও চালকের নাম পরিচয় দেওয়ার পরেও তাদের গ্রেপ্তার করা হলো। নির্বাচনের মূল এজেন্ট মনিরুল ইসলাম রবিকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি এটিএম কামাল, আতাউর রহমান মুকুল, আবু আল ইউসুফ খান টিপুর বাড়িতে নিয়মিত পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। নেতাকর্মীদের ভয়ে রেখেছিল। ১৬ ডিসেম্বর বিএনপির র্যালিতে আমাকে যোগ দিতে দেয়নি নির্বাচন কমিশনার। অথচ বিধি ভেঙে প্রতিদিন এমপিরা এসে নারায়ণগঞ্জে আইভীর পক্ষে সমাবেশ মিছিল করেছে।
তৈমূর বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এসে প্রশাসনকে চাপ দিয়েছে। তাদের অতিরঞ্জিত কথার পরে গ্রেফতার শুরু হয়। ভোটের দিন হাতি মার্কা ব্যাচ থাকা মনোয়ার হোসেন শোখন, সিদ্ধিরগঞ্জের মান্নান সহ অনেক লোকজনদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেশ কিছু কেন্দ্রে ইভিএম ত্রুটিপূর্ণ ও স্লো ছিল। অনেক লোক ভোট দিতে পারেনি। ইভিএমের কারচুপির জন্য আমাদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :