আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপির সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীরাও নানা হিসেব নিকেসে করতে শুরু করেছেন। যদিও বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে এখনও কোনো নিশ্চয়তা আসেনি। তবে যদি বিএনপি নির্বাচনে আসে তাহলে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীরা কে কতটুক দৌড়ে এগিয়ে থাকতে পারবেন তা নিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিযোগিতা চলমান রয়েছে।
আর এই প্রতিযোগিতার লড়াইয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বর্তমানে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য আতাউর রহমান আঙ্গুর। সেই সাথে তার বিপরীতে বর্তমানে বেকায়দার রয়েছেন বিএনপির সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ। যিনি গত মেয়াদে নারায়ণগঞ্জ-২ আসন তথা আড়াইহাজারে বিএনপি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। একই সাথে সাথে নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট আশাবাদীও ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কুলিয়ে উঠতে পারেনি।
গত সংসদ নির্বাচনের পর ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও আড়াইহাজারে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে যেন তিনি অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছেন। তাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে আসছেন সাবেক সংসদ সদস্য আতাউর রহমান আঙ্গুর। সেই সাথে দিন যাওয়ার সাথে সাথে তার সম্ভাবনাই প্রবল হচ্ছে।
দলীয় সূত্র বলছে, অনেক দিন ধরেই নারায়ণগঞ্জ বিএনপিকে শাসন করে আসছিলেন বিএনপির সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ। নারায়ণগঞ্জ বিএনপির ক্ষেত্রে তিনি অঘোষিত নিয়ন্ত্রক বনে গিয়েছিলেন। তার কথায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপিসহ যে কোনো অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কমিটি ঘোষণা করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তিনি তার সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন আর আগের মতো তিনি নারায়ণগঞ্জ বিএনপিকে শাসন করতে পারছেন না।
নারায়ণগঞ্জ বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের রাজনীতিতে নজরুল ইসলাম আজাদ অঘোষিত নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠলেও তাদের প্রভাবের ‘মেরুদ-’ ভেঙে দেওয়া হয়েছে জেলা বিএনপির ৯ সদস্যের আহবায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর জেলা বিএনপির আহবায়ক করা হয়েছে সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন ও সদস্য সচিব হয়েছেন গোলাম ফারুক খোকন। এ দুইজনের পদায়নে কর্তৃত্ব খর্ব হয়ে গেছে বিএনপির সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের। মূলত এ নেতা মুঠোবন্দী ছিল জেলা বিএনপির রাজনীতি। আর সবশেষ আহবায়ক কমিটি ছিল এ নেতার তল্পিবাহক ও পোষ্য। অনেকেই আজাদের ‘কালো হাত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বর্তমানে সে হাত ভেঙ্গে গেছে।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, কয়েক বছর ধরেই বিএনপিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন আজাদ। তিনি যেভাবেই চাইতেন সেভাবেই দলের কমিটিগুলো ঘোষণা হতো। সেই সাথে কয়েকটি কমিটিও ঘোষণা হয়েছিল। আর সে কারণে নারায়ণগঞ্জ বিএনপির শীর্ষ নেতারাও নিজেদের প্রটোকল ভেঙে তাঁদের খুশি করতে ছুটে চলেন তাদের বাড়িতে করেন লেজুরবৃত্তি। এসব নিয়ে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম ক্ষোভ ও হতাশা।
তার এতটাই ক্ষমতা ছিল যে আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির ১০১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে যেখানে ঠাঁই মিলেনি সাবেক এমপি ও উপজেলা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতির। কমিটির কোথায় স্থান পাননি আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাহমুদুর রহমান সুমনসহ তার অনুসারীরা। অথচ মাহমুদুর রহমান সুমন, তার পিতা মরহুম বদরুজ্জামান খান খসরু এবং সাবেক সংসদ সদস্য আতাউর রহমান আঙ্গুর আড়াইহাজার বিএনপির অন্যতম নেতা হিসেবে বিবেচিত।
সূত্র বলছে, মহানগর বিএনপির বর্তমান আহবায়ক সাখাওয়াত হোসেন খানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত পারভেজ মল্লিক একদা আজাদকে জুতাপেটা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপরেই দুদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন পারভেজ মল্লিক। কোথায় ছিলেন, কোথায় থেকেছেন কিছুই বলেননি পরিবারকে। নেতাকর্মীদের কাছ থেকেও ছিলেন দূরে। পরবর্তীতে এক নাটকের মাধ্যমে পারভেজ রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। একই সাথে নিজের বক্তব্যের জন্য অনুশোচনাও করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, পারভেজকে চাপের মুখে রেখে এই ঘোষণা দিতে বাধ্য করান আজাদ।
এদিকে, গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির কর্মসূচিতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনার পর নিহত হয় যুবদল কর্মী শাওন। সেই ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হলেও আজাদের অনুসারীরা মামলার বাইরে থেকে গেছেন বিস্ময়করভাবে। এমনকি শাওনকে যেই নেতা নিয়ে এসেছিল মিছিলে, সেই নেতার নামও আসেনি এই মামলায়। বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীনদের সাথে যোগাযোগ থাকায় আজাদ অনুসারীরা মামলা থেকে রেহাই পেয়ে গেছেন। এভাবেই পুরো বিএনপিতে পৃথক বলয় তৈরি করে রেখেছিলেন আজাদ।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণা হওয়ার পর আজাদের সকল ক্ষমতা যেন মাটির সাথে মিশে গেছে। এখন আর আগের মতো তাকে কেউ মূল্যায়নও করেন না।
স্থানীয় রাজনীতিতে গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে বিরোধ ছিল আজাদের। কারণ আজাদের পক্ষের লোক ছিলেন মামুন মাহমুদ। তাকে দিয়ে তিনি কমিটিগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। আর গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে মামুন মাহমুদের ছিল দা কুমড়া সম্পর্ক। এসব কারণে দীর্ঘ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পদহীন ছিলেন গিয়াসউদ্দিন। তার অনুগামী কাউকেই দলে ঠাঁই দেওয়া হয়নি।
অপরদিকে, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব গোলাম ফারুক খোকন মূলত রূপগঞ্জের দিপু ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠজন। এ দিপুকে নিয়ে ছিল মামুন ও আজাদের নানা কূটকৌশল। কারণ রূপগঞ্জে আজাদ ও মামুন মিলে সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামানকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। এছাড়া জেলা যুবদলের কমিটি নিয়েও ছিল বিরোধ। সবকিছুকে ছাপিয়ে এবার নেতৃত্বে গিয়াস ও খোকন। ফলে খর্ব হয়ে গেছে মামুন ও আজাদদের কর্তৃত্ব।
আর এভাবে আজাদের কর্তৃত্ব খর্ব হওয়াতে আড়াইহাজার বিএনপির রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনায় চলে এসেছেন আতাউর রহমান আঙ্গুর। সেই সাথে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে হয়তো নির্বাচনী মোড় আঙ্গুরের দিকেই মোড় নিবে। সেই সাথে মরহুম বদরুজ্জামান খান খসরুর ছেলে মাহমুদুর রহমান সুমনেরও প্রভাব বাড়বে বিএনপির রাজনীতিতে।
আপনার মতামত লিখুন :