ইকবাল আহমেদ গত পাঁচ বছর ধরে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছেন। সর্বসাকুল্যে বেতন পাচ্ছেন ২২ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া ও গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল পরিশোধেই বেতনের অর্ধেক টাকা শেষ। বাকি টাকা দিয়ে কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চালান। শুধু ইকবাল আহমেদই নয়, নগরীর বেশিরভাগ বেসরকারি চাকরিজীবীর অবস্থা অনেকটা এরকম।
শফিকুল মিয়া। ১৯ বছরের তরুণ। পেশায় অটোচালক। গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার ইশ্বরদীতে। সে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর তালা ফ্যাক্টরি এলাকায় থাকে। এই এলাকারই একটি গ্যারেজের অটো ভাড়ায় চালায়। অটোর ভাড়া দৈনিক সাড়ে ৪ শত টাকা। ভোর ৬টা থেকে দুপুর একটা বা দেড়টা পর্যন্ত অটো চালিয়ে ৫’শ টাকা কামাই করতে পারেন। মানে এক বেলায় অটোর ভাড়া উঠে। পরবর্তীতে রাত ১০টা পর্যন্ত অটো চালালে আরও ৪-৫ শত টাকা আয় করা যায়। মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করতেই কষ্ট হয়। মেসে থাকা ও খাওয়ার খরচ। এরপর গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানো দায়। টেনেটুনেই চলতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র সংবাদকর্মী জানালেন দুর্দশার কথা। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিন ছেলে মেয়ের পড়াশোনা খরচ। সংসারের খরচ। মাস শেষে বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, ছেলে মেয়েদের টিউশন ফি। স্কুল কলেজের বেতন। যাতায়াত খরচ বেড়েছে। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর মূল্য এখন আকাশচুম্বী। সবাই সবকিছুর দাম বাড়িয়ে এডজাস্ট করেন। বেচারা সংবাদকর্মীতো বেরসকারি চাকুরে। তাদের বেতন কাঠামো নির্দিষ্ট। বাজারে গেলে ঠিকমত বাজার করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
পশ্চিম দেওভোগ মাদ্রাসা বাজারে কথা হয় একজন শাক-সবজি বিক্রেতার সাথে। তার নাম আসগর আলী। বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আসগর আলী বসে আছেন তার ভ্যান গাড়ির কর্ণারে। কিছু সাদা পুঁই, ডাটা ও পাটশাক নিয়ে বসে আছেন। বিক্রি হচ্ছে না। আজগর আলী জানালেন, ৭ জনের সংসার। তিনি শাক বিক্রি করে তিনশত টাকার বেশি আয় করতে পারেন না। কোনদিন দুইশত টাকাও আয় হয়। এক আঁটি পাটশাক ত্রিশ টাকা। ডাটা একমুঠো ত্রিশটাকা। মানুষ নিতে চায় না। তাই নির্দিষ্ট কোন বাজারে নয় ঘুরে ঘুরে শাক বিক্রি করেন। খুব কষ্টে ঘুরছে তার সংসারের চাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে যারা মাসে ২০-২৫ হাজার আয় করেন, এমন লোককেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়া নিম্নবিত্ত লোক আলু ভর্তা, ডাল, ডিম খাবে, সেখানেও খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। বর্তমানে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। মোটা মসুর ডালের কেজি ১২০ টাকা এবং ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। তাই গরীব মানুষ একটি ডিম পরিবারের চারজনে ভাগ করে খাচ্ছেন। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সবজির পরিমাণও কমছে। খরচ বাড়তে থাকায় অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
খুচরা বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা, পেঁয়াজ ৬৫-৭০ টাকায়, রসুন ১৮০ টাকা, আদা ২০০ টাকা এবং সয়াবিন তেল এক লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৭৪ টাকা। এছাড়া বাজারে মোটা সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়, আতপ চাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৬০ থেকে ৯০ টাকায়। অপরদিকে ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৯৫ টাকায়। এছাড়া পাঙ্গাস মাছ বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা, তেলাপিয়া ২২০ টাকা এবং রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা। অপরদিকে বাজারে বর্তমানে ৬০-৮০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই।
এদিকে, নগরীর নিতাইগঞ্জ ও দ্বিগুবাবু বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে কমেছে। তবে আমাদের দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানির খরচ বেড়ে গেছে। কোনো ব্যবসায়ী তো আর লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবেন না। অপরদিকে খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিমত, পাইকারদের থেকে একটা নির্দিষ্ট মুনাফায় খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনে। বর্তমানে দোকান ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ খরচ বেড়েছে। আমাদের অতি মুনাফা করার সুযোগ নেই।
তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার শুধুমাত্র রমজান এলেই বাজার মনিটরিং করে। মনিটরিংয়ের অভাবে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ইচ্ছে মতো বাড়ায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান তারা।
সাধারণ মানুষের অভিমত, দেশের চাকরি বাজারে এখনো বেশিরভাগ মানুষের বেতন সীমা ১৫ থেকে ২৫ হাজারের ঘরে। আজ থেকে ৫ বছর আগে সেই টাকায় মোটামুটি সংসারের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব ছিল। এখন এই সময়ের ব্যবধানে প্রত্যেক পণ্যের দামই দ্বিগুণ কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গেছে। নিত্যপণ্যের সাথে বাসা ভাড়া, সন্তানের পড়াশুনোর খরচ, যাতায়াত ও চিকিৎসার খরচ মেটাতে মাসের প্রথম সপ্তাহে ৯০ শতাংশ টাকা শেষ। বাকি সময়টা আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধারদেনা করে করে চলতে হচ্ছে মধ্যবিত্তশ্রেণির।
আমজনতার উদ্ধৃতি দিয়ে নারায়ণগঞ্জ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নেতৃবৃন্দ বলেন, আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থাপনার প্রতি পদে পদে রয়েছে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। এসব সিন্ডিকেট সরকারকেও জিম্মি করে ফেলে। যেমন- নিতাইগঞ্জে প্রশাসন অভিযান চালাতে গেলে ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে পালিয়ে যান। তাই প্রশাসন কি থেমে থাকবে? সাধারণ মানুষের মতে, এ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হওয়া দরকার, যারা ভোক্তাদের জিম্মি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়ান।
আপনার মতামত লিখুন :