নারায়ণগঞ্জের গত কয়েক দশকের ইতিহাসে সাত খুনের ঘটনাটি সবচেয়ে বেশী আলোচিত। সাতজনকে একসঙ্গে অপহরণের পর নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ ফেলে দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে। ২০১৪ সালের ৩০এপ্রিল বন্দরের শান্তিনগর এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে উঠেছিল র্যাব কর্তৃক অপহৃত হওয়া সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার সহ ৬ জনের লাশ। পরদিন ১মে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে আরও একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
৩০ এপ্রিল বিকেলে যখন একের পর এক লাশ উদ্ধার হয় তখনই সবাই নিশ্চিত হয় অপহরণের ৭জনের লাশগুলোই এগুলো। মুহূর্তের মধ্যে শীতলক্ষ্যার পাড়ে জড়ো হতে থাকে লোকজন। কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহতে পরিবারের লোকজন। সেই বীভৎস দিনের কথা স্মরণ করে এখনো আতকে উঠে লোকজন।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার এবং তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন। পরদিন ২৮ এপ্রিল ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন নজরুল ইসলামের স্ত্রী। কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান করে মামলায় আসামি করা হয় ৬জনকে।
৩০ এপ্রিল প্যানেল মেয়র নজরুলের ভাই আব্দুস সালাম ও স্ত্রী সেলিনা ইসলাম নজরুলের লাশ শনাক্ত করেন। এছাড়া নজরুলের সঙ্গেই অপহৃত মনিরুজ্জামান স্বপনের লাশ তার ছোট ভাই রিপন এবং তাজুল ইসলামের লাশ তার বোন শিরীন আক্তার শনাক্ত করেন। আরেকটি লাশ অপহৃত আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের বলে শানাক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ হাসপাতালের মর্গে অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের লাশের পরিচয় শর্নাক্ত করেন তারা ছেয়ে সেতু সরকার ও মিতু সরকার।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাশ ৬টি এক কিলোমিটারের মধ্যে পায়ে ২৪টি করে ইট বোঝাই সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বাঁধা অবস্থায় নদীতে ডোবানো ছিল। পা ছিল দড়ি দিয়ে বাঁধা। হাত পেছনে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। মুখ ডাবল পলিথিন দিয়ে গলার কাছে বাঁধা ছিল। পেট ধারালো অস্ত্র দিয়ে সোজাসুজি ফাড়া ছিল।
প্যানেল মেয়র নজরুলের লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ। তার সমর্থকেরা সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে যানবাহনের ব্যাপক ভাঙচুর চালায়, বিক্ষুদ্ধ জনতা ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের মৌচাক এলাকায় অবস্থিত সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও অপহরণ মামলার ২নং আসামী যিনি ইতোমধ্যে অব্যাহতিপ্রাপ্ত হাজী ইয়াসিন মিয়ার মালিকানাধীন সামস ফিলিং স্টেশন নামের একটি পেট্রোল পাম্পে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় তারা পেট্রোল পাম্পের ভেতরে থাকা একটি ট্রাক ও বাসে অগ্নি সংযোগ করা হয়।
এদিকে লাশ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়লে সাইনবোর্ড থেকে কাচঁপুর ব্রীজ পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষ। সর্বত্র জ্বলে উঠে ক্ষোভে আগুন। তাদের দেওয়া আগুনে পুরো এলাকা জুড়ে বিরাজ করে পোড়া গন্ধ।
সাতজনের অপহরণের এর আগে নূর হোসেন অত্যাচারের ভয়ে কেউ মুখ না খুললেও সিটি করপোরেশনের ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল সহ আরোও ৭জনের লাশ উদ্ধারের পর লাঠিসেটা নিয়ে নিয়ে নেমে আসে ঢাকা-চট্রগ্রাম ও ঢাকা সিলেট মহাসড়কে। টানা ৪ দিন চলে অবরোধ ও অগ্নি সংযোগ।
৩০ এপ্রিল নজরুল ইসলাম সহ বাকিদের লাশ উদ্ধারের পর সেই বিস্ফোরণ অগ্নিগিরির মত ছড়িয়ে পড়ে। উত্তাল হয়ে উঠে সিদ্ধিরগঞ্জ জ্বলতে থাকে মহাসড়ক সহ নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা-আদমজী সড়ক। ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নজরুল হত্যা মামলার ২নং আসামী হাজী ইয়াসিন মিয়ার মালিকানাধীন শ্যামস ফিলিং স্টেশন।
ইতোমধ্যে আলোচিত সাত খুন মামলার রায়ে প্রধান আসামী নূর হোসেন সহ অন্যদের ফাঁসি ও বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়। সাত খুন নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস তো বটেই দেশের ইতিহাসে ন্যাক্কারজনক ঘটনার একটি। কলংক এটে দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জবাসীর ললাটে।
সেই ঘটনা
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়। একই সময়ে একই স্থানে আরেকটি গাড়িতে থাকা নারায়ণগঞ্জ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার চালককে অপহরণ করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর বন্দর উপজেলা শান্তির চর এলাকায় শীতলক্ষ্যা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাত জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
ওই ঘটনায় নিহতরা হলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম। তিন জন তদন্তকারী কর্মকর্তার ১১ মাসের দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল ভারতের কলকাতায় গ্রেপ্তার নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এজাহারভুক্ত ৫ আসামি অব্যাহতির আবেদন করা হয়। মামলায় ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়। ১৬২ ধরনের আলামত উদ্ধার দেখানো হয়েছে। ২০১৪ সালের ১৪ জুন রাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের অদূরে কৈখালি এলাকার একটি বাড়ি থেকে নূর হোসেন ও তাঁর দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে বাগুইআটি থানার পুলিশ। পরে ওই বছরের ১৮ আগস্ট নূর হোসেন, ওহাদুজ্জামান শামীম ও খান সুমনের বিরুদ্ধে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগে বারাসাত আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় বাগুইআটি থানা পুলিশ। ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দমদম কারাগার কর্তৃপক্ষ নূর হোসেনকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ১৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ আদালতে উপস্থাপন করা হয় নূর হোসেনকে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়। এরপর একই বছরের ২২ জানুয়ারি নিম্ন আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্স তথা মৃত্যুণ্ডের অনুমোদনের জন্য পূর্ণাঙ্গ রায়সহ যাবতীয় নথি পাঠানো হয় হাইকোর্টে।
পরে কারাবন্দি আসামিরা পর্যায়ক্রমে আপিল করেন। এ আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট রায় দেন। রায়ে ১৫ জনকে নিম্ন আদালতের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়। আর ১১ জনকে নিম্ন আদালতের মৃত্যুদ-ের সাজার পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ ছাড়া নিম্ন আদালতে ৯ জনকে দেয়া বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। নিম্ন আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য পাঠানো ডেথ রেফারেন্স ও কারাবন্দি আসামিপক্ষের করা আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট এ মামলায় রায় ঘোষণা করে। মামলাটি এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।
ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছিলো, দন্ডিতরা যে ধরনের অপরাধ করেছেন তারপরও যদি তাদের উপযুক্ত সাজা না দেওয়া হয় তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা তৈরি হবে। দেশের জনগণের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় র্যাবের প্রতি মানুষের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। কিন্তু কতিপয় সদস্যের কারণে সামগ্রিকভাবে গোটা বাহিনীকে দায়ী করা যায় না। কিছু উশৃঙ্খল র্যাব সদস্যের কারণে এ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে না। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ পূর্ণাঙ্গ রায়টি লিখেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :