চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ে গরম বেশি। তবে মাঝে মধ্যে বৃষ্টিও হচ্ছে। তাই বলে বর্ষা এখনো আসেনি। ফলে নগরীতে মশার যন্ত্রণা ও ওয়াসার পানি নিয়ে অভিযোগ কমেনি। উত্তর চাষাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা জানালেন, ইফতারের সময় ওয়াসার পানিতে কুলিটুকু পর্যন্ত করা যায় না। অজু করতে গেলে বমি চলে আসে। দুপুরে গোসল করতে গেলে শরীর গিন গিন করে। ওয়াসার পানি বোধ হয় ইদানিং আর বিশুদ্ধ করা হয় না। মনে হয় নদী থেকে পচা পানি তুলে ডাইরেক্ট সাপ্লাই লাইনে দেয়া হয়। মেয়র কি করে। তিনি কেনো ওয়াসার দায়িত্ব নিয়েছেন। কাউন্সিলররা ওয়াসার প্রকৌশলীদের মত বক্তব্য দেন যে, বর্ষা আসলে বৃষ্টিপাতের পর এই সমস্যা সমাধান হবে। মানুষকে সেবা দিতে না পারলে মেয়র ওয়াসার দায়িত্ব ছেড়ে দিক। আমরা নগরবাসী কেনো মিছে মিছে কষ্ট করবো। পানির অপর নাম জীবন। রোজার মাসে বিশুদ্ধ পানি পাবোনা এটা কেমন কথা ! নাসিক এবং ওয়াসার কর্মকর্তারা আর কত বৃষ্টির অজুহাত দিবেন।
মশার কামড়ে মহানগরবাসী অতীষ্ঠ। ওয়াসার ময়লা ও দুর্গন্ধময় পানিতে দুর্ভোগের অন্ত নেই। প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ অভিযোগ করেও কোন সুফল পাচ্ছেনা। যে যার ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে সমাধান জানতে চাইছে বার বার। কাউন্সিলররা সিটি কর্পোরেশনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানছেন সহজ সমাধান। স্বাস্থ্য বিভাগ এবং ওয়াসা থেকে বলে দেয়া হচ্ছে ক’দিন বাদেই বর্ষা আসবে। বৃষ্টি হলেই এই সমস্যা আর থাকবে না। স্বাস্থ্য বিভাগের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পরিদর্শক বলেছেন, সব ওয়ার্ডেই নিয়মিত মশার ঔষধ ছিটানো হচ্ছে। বর্ষাকাল আসলে বৃষ্টি হলেই মশার দাপট প্রাকৃতিকভাবেই কমে যাবে। দক্ষিণা বাতাস ছাড়লে মশা উড়ে যাবে। বৃষ্টির পানিতে মরে যাবে। তবে বৃষ্টির পর আমাদের সবাইকে সাবধান থাকতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি জমে না থাকে। তখনো মশার ঔষধ ছিটানো হবে। মশার অত্যাচার থাকবে না।
এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থা শীতলক্ষ্যা নদীর পানির জানালেন নারায়ণগঞ্জ ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী। অধিকতর পরিশোধন করেও পানির দুর্গন্ধ দূর করা যাচ্ছে না। বরং ক’দিন ধরে বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছেই। বর্ষা আসলে আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবো। বর্ষাকাল আসলে বৃষ্টিপাত হবে। নদীতে পানি প্রবাহ বাড়বে। নতুন পানি আসবে। সবমিলিয়ে শীতলক্ষ্যার পানির দূষণের মাত্রাটা তখন কমে আসবে প্রাকৃতিকভাবেই। পরিশোধনে ঝাঝালো দূর্গন্ধ থাকেনা। শুষ্ক মৌসুমের শেষ সময়। নদীর পানি প্রবাহ একেবারেই কমে গেছে। তাই শিল্পবর্জ্য, পয়োবর্জ্য ও পলিথিন বর্জ্য মিশে শীতলক্ষ্যার পানি গাঢ় কালচে বর্ণ ধারণ করেছে।
শীত শেষে শুষ্ক মৌসুমে অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গেছে শীতলক্ষ্যার পানি। শিল্পবর্জ্যরে প্রভাবে পানিতে অক্সিজেন এর পরিমাণ কমে যাচ্ছে। শীতলক্ষ্যা নদীতে লিটার প্রতি ডিও মেনাস ডিজলভ অক্সিজেন থাকার কথা ৪-৬ মিলিগ্রাম। কিন্তু বর্তমানে আছে মাত্র ১-২ মিলিগ্রাম। নদীর পানিতে অক্সিজেন বেশি মাত্রায় কমে যাওয়ায় মাছসহ জলজ প্রাণী টিকতে পারছে না। স্বচ্ছ পানি কালচে রঙ ধারণ করেছে। সঙ্গে আছে দুর্গন্ধ। পাগলা, নয়ামাটি, সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল, শিমরাইল, ডেমরা, কোনাপাড়া, রূপগঞ্জ, কাচঁপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় চার হাজারের বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত ডাইং, কেমিক্যাল বর্জ্যসহ পলিথিন এবং পয়ঃনিষ্কাশন বর্জ্যসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নদীতে এসে পড়ে।
এছাড়া খাল বিল, ক্যানেল ও ড্রেনের মধ্যে ময়লা আবর্জনা এসে পড়ছে এ নদীতে। কুচকুচে কালো আর উৎকট দুর্গন্ধের পানি ব্যবহার তো দূরের কথা, নদী পথে চলাচলই এখন দুরূহ হয়ে উঠেছে। নারায়ণগঞ্জের চর সৈয়দপুর থেকে নরসিংদীর পলাশ পর্যন্ত কমপক্ষে অর্ধশতাধিক নালা, ড্রেন ও খাল দিয়ে এসে পড়া শিল্প বর্জ্য, পয়ঃনিষ্কাশন বর্জ্যসহ নানা বর্জ্যের কারণে শীতলক্ষ্যা রূপ হারিয়েছে। বর্জ্যের কারণে শুধু শীতলক্ষ্যাই নয়, নারায়ণগঞ্জের সব খাল-বিল ও নালার পানিও দূষিত হয়ে উঠেছে। পরিবেশ অধিদফতরের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিদিন শুধু অপরিশোধিত ১২/১৩ কোটি লিটার শিল্প বর্জ্য বিভিন্ন খাল-বিল দিয়ে এসে শীতলক্ষ্যায় পড়ছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের পয়ঃনিষ্কাশন ও গৃহস্থালী বর্জ্য, পলিথিন, বাজারের উচ্ছিষ্ট অংশ, হোটেল রেস্তোরাঁর বর্জ্যসহ আরও কয়েক কোটি লিটার বর্জ্য এসে মিশে শীতলক্ষ্যায়। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, শুধু নারায়ণগঞ্জ অংশে তরল বর্জ্য নির্গমনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩১৮টি। প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠানেই পরিশোধন প্রকল্প ইটিপি প্ল্যান্ট রয়েছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ না বাড়াতে ইটিপি প্ল্যান্ট চালানো হয় না বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে। যে কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর অপরিশোধিত বর্জ্যে দিন দিন নদীর পানির রঙ কালচে হয়ে পড়ছে।
পরিবেশ অধিদফতরের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিদিন নরসিংদী, গাজীপুর, রূপগঞ্জ ও ঢাকার একাংশের শুধু অপরিশোধিত কয়েকহাজার কোটি লিটার শিল্পবর্জ্য বিভিন্ন খাল-বিল দিয়ে এসে শীতলক্ষ্যায় পড়ছে। এছাড়া সিটি করপোরেশনের পয়ঃনিষ্কাশন ও গৃহস্থালী বর্জ্য, পলিথিন, বাজারের উচ্ছিষ্ট অংশ, হোটেল রেস্তোরাঁর বর্জ্যসহ আরও কয়েক কোটি লিটার বর্জ্য এসে মিশছে শীতলক্ষ্যায়। কুচকুচে কালো আর উৎকট দুর্গন্ধের পানি ব্যবহার তো দূরের কথা, নদী পথে চলাচলই এখন দুরূহ হয়ে উঠেছে।
এদিকে, নারায়ণগঞ্জ মহানগরী (সিদ্ধিরগঞ্জ বাদে) এলাকায় নতুন নেটওয়ার্কিং করার ফলে মহানগরবাসী সবচেয়ে বেশি বিশুদ্ধ পানি পাবেন। এডিবি’র প্রকল্প বাস্তবায়নে চায়নীজ কোম্পানী পানীয় জলের বিশুদ্ধতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। নতুন নেটওয়ার্কের সাথে কোম্পানীটি গোদনাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টকে পুরোপুরি সংস্কার করে দিবে। সে সাথে এই পানি শোধনাগারের উৎপাদন ক্যাপাসিটিও দ্বিগুন বাড়াবে। বর্তমানে গোদনাইল পানি শোধনাগারে দৈনিক ২ কোটি ৩০ লাখ লিটার পানি শোধন করে সরবারহ করা হয়। এই ক্যাপাসিটি দৈনিক ৪ কোটি ৫০ লাখ লিটারে উন্নীত করা হবে। এবং শুস্ক মৌসুমে ওয়াসার পানিতে শীতলক্ষ্যার ময়লার দুর্গন্ধ থাকবে না।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ওয়াসার নেটওয়ার্ক নেই। ১ থেকে ৫নং ওয়ার্ডে ওয়াসার নেটওয়ার্ক না থাকায় সেখানকার বাসিন্দারা ডীপ টিউবওয়েল বসিয়ে পানি সংগ্রহ করে। ভবিষ্যতে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে ওয়াসা। ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানির উপর বেশি জোর দিতে বলা হচ্ছে। বিশেষ করে নদী-নালা, খালবিল, পুকুর-জলাশয়ের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ডিপটিউবওয়েল এর উপর নির্ভরশীলতা কমাতেই ওয়াসার নেটওয়ার্ক তৈরীর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তাছাড়া এলাকাবাসীও ওয়াসার গ্রাহক হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অনেক এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট চরমে। সিদ্ধিরগঞ্জের দিনে দিনে ১ থেকে ৫ নং ওয়ার্ড এলাকায় বিশুদ্ধ পানির চাহিদা বাড়ছে।
এদিকে, করপোরেশনের বেশকিছু এলাকায় মশারি, কয়েল আর স্প্রে করেও প্রতিকার মিলছে না। ফলে মশাবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। মশার কামড়ে হাত-পা ফুলে যায়। সেই ফুলে যাওয়া অংশে চুলকানী হয়। একপর্যায়ে ঘা এর আকার ধারন করে।
কীটতত্ত্ববিদদের মতে, গ্রেটার ঢাকা বিভাগে মার্চে মশার ঘনত্ব চারগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। যদিও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন বলছে, মশার উপদ্রব বাড়লেও নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। নিয়মিতই ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম চালাচ্ছে নাসিক। তবে নগরবাসী বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হয়। তাও নিয়মিত নয়। মশককর্মীরা যেসব ওষুধ ছিটায় তা শুধু ধোঁয়া ছাড়া সেখানে কিছুই নেই। ওষুধের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ ছাড়া বস্তি ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে মশার উপদ্রব থাকলেও সেখানে সিটি করপোরেশনের কোনো তৎপরতা নেই। বিভিন্ন সময় মশক কর্মীরা ফগার মেশিন কাঁধে নিয়ে ঘুরে দেখে যায়।
আমলাপাড়া, প্রেসিডেন্ট রোড, গলাচিপা, পাইকপাড়া, নিতাইগঞ্জ, দেওভোগ, বাবুরাইল, জল্লারপাড় ও মাসদাইর এলাকার বাসিন্দারা জানান, মশার কামড়ে অতিষ্ঠ সেখানকার জনজীবন। দিনরাত সমান তালে কামড়াচ্ছে মশা। দরজা জানালা আটকা রাখলেও নিস্তার মিলছে না। সব সময় বাসায় মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। বিশেষ করে বাচ্চাদের নিয়ে বিপাকে সেখানকার অভিভাবকেরা। তারা বলছেন, শিশুদেরকে বাসায় আটকিয়ে রাখা যায় না। বাসায় থাকলেও সারাক্ষণ হাত-পায়ে মশার কামড়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেন। বাইরেও একই অবস্থা। কোথাও দাঁড়ানো কিংবা বসা যায় না। মাঝে মধ্যে মশককর্মীরা আসলেও তাদের ওষুধে মশা মরে না।
গলাচিপা, নন্দিপাড়া ও গোয়ালপাড়ার বাসিন্দারা জানান, মশার কামড়ে হাত-পা ফুলে উঠছে। সারাক্ষণ কানের কাছে গুনগুন করছে। কয়েল, স্প্রেতে কাজ হয় না। এত মশা আগে দেখিনি। গত এক সপ্তাহে ব্যাপক হারে বেড়েছে। সিটি করপোরেশনের কোনো খবর নেই। লোকজনও আসে না। আগে নিয়মিত ওষুধ ছিটালেও গত এক মাসেও একবার দেখি না। পাশেই নন্দিপাড়া। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সেখানে ঘুরতে গিয়ে ৫ মিনিটও থাকতে পারি নাই। মশা এমনভাবে ঘিরে ধরেছে যেন তুলে নিয়ে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :