‘গরীব মাইনষের কোন দাম নাই। এই যে সকাল থেইক্কা লাইনে দাঁড়াইছি। অহন বেলা পৌণে একটা বাজে। সামনে ট্রাকে মাল। প্যাকেটও রেডি। কিন্তু মাল দিতাছে না। আজকা কামে যাইতে পারি নাই। অহন কইতাছে কালকে মাল দিব।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন সাবিহা আক্তার। ১২ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। পেশায় গার্মেন্টস শ্রমিক।
বেলা ১১টায় দেওভোগ পানিরট্যাংকী এলাকায় কথা হয় মামুন, সোহলে ও আম্বিয়া বেগমের সাথে। এরা সবাই টিসিবি কার্ডধারী। গতকাল মঙ্গলবার দ্বিতীয় ফেজের মাল তোলার কথা। মাল নিয়ে ট্রাক রেডি। কিন্তু টিসিবি বিতরণ করা হয়নি। পাইকপাড়া ঋষিপাড়া এলাকার জমু, মিনারা ও জলিলের মুখে একই কথা ‘সকাল থেইক্কা লাইনে খাড়াইলাম। মাল তুলতে পারলাম না। আমরা গরীব বইল্লা আমাগো সময়ের কি কোন দাম নাই ?
নগরীর মাসদাইর এলাকার রমজান, বিথী, জামিল ও মাহাবুব জানায়, দুই ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তারা টিসিবি’র মাল পায়নি। কাউন্সিলরও কোন উত্তর দিতে পারে নাই। খালি কইছে ডিসি অফিসের নির্দেশে মাল বিতরণ বন্ধ। শহরের পাইকপাড়া, তামাকপট্টি, ঋষিপাড়া, ডনচেম্বার ও খানপুর এলাকার বাসিন্দারা দুপুর পর্যন্ত টিসিবি’র পন্যের অপেক্ষা ছিলেন।
নগরীর কয়েকটি ওয়ার্ড থেকে টিসিবি পণ্যের জন্য অপেক্ষমান মানুষদের অভিযোগ পেয়ে দু’জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে টিসিবি’র মাল বিতরণ বন্ধ কেনো-একথা জানতে চাইলে তারা সঠিকভাবে কিছুই বলতে পারলেন না। শুধু এটুকু বললেন ডিসি অফিসের নির্দেশে মাল বিতরণ বন্ধ আছে। এ বিষয়ে পরিস্কার কোন তথ্য মিললোনা। দুপুর পৌণে ১টায় এ প্রতিবেদক ডিসি অফিসে গিয়ে এডিসি জেনারেল সাকিব আল রাব্বি’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখনো এ ধরনের কোন ঘটনা জানি না। আমি ঘটনা জেনে আপনাকে জানাবো। আপনি নাসিক এর সিইও মহোদয়ের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন।
এডিসি জেনারেল এর পরামর্শে নাসিক এর সিইও জনাব শহিদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ডিসি সাহেব ডিও দেয়া বন্ধ রেখেছে। তাছাড়া আমরা টিসিবি’র পণ্য বিতরনের একটা রোস্টার তৈরী করে দিই। ডিও দেন ডিসি সাহেব। রোস্টার অনুযায়ী মঙ্গলবার নাসিক এর ২৭ টি ওয়ার্ডেই টিসিবি’র মাল বিতরনের কথা। ডিও সংক্রান্ত ঘটনার কারণেই বোধ হয় এটা বন্ধ রয়েছে। বেটার হয় আপনি ডিসি সাহেব এর সাথে আলাপ করে তথ্যটা যাচাই করে নেন।
পরবর্তীতে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রশাসক মো: মঞ্জুরুল হাফিজ দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জকে জানান, টিসিবি’র মাল বাইরে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ পেয়েছি। আমি ডিও দেয়া বন্ধ রেখেছি। তাই মাল বিতরণ বন্ধ আছে। যে সকল ডিলার আগে মাল তুলেছে তাদেরও একই নির্দেশ দেয়া আছে। মাল বন্ধ রাখার কারণ ডিজিটাল কার্ড। সকল ওয়ার্ডে শতভাগ ডিজিটাল কার্ড না হলে মাল বিতরণ করা হবেনা। গতকালও ১০ হাজার কার্ড হয়েছে। প্রায় ৯০ হাজারের মত ডিজিটাল কার্ড তৈরী হয়ে গেছে। ১ লাখ ৫ হাজার কার্ড তৈরী হতে আর বাকি নেই। দুই তিন দিন লাগবে।
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, ডিজিটাল কার্ড করতে আমরা বাধ্য হয়েছি। সরকারের দেয়া পণ্য যাতে সঠিক ব্যক্তিটির হাতেই পৌঁছায় এ জন্য ডিজিটাল কার্ড তৈরী করা হচ্ছে। এমনও হয়েছে যে, একই ব্যক্তি দুই বার নাম ঠিকানা একটু এদিক সেদিক করে টিসিবি কার্ড পেয়েছে দুইটি। এমন ডুপ্লেক্স কার্ড আমরা চিহ্নিত করেছি প্রায় ২৮ হাজারের মত। ম্যানুয়েল কার্ড দিয়ে এই ফাঁকিবাজি ধরা মুশকিল।
তাই সরকার ডিজিটাল কার্ড তৈরী করছে। এখন জেলা প্রশাসনের কাছে প্রকৃত তথ্য সরবারহ করতে পারে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। এবার ডিজিটাল কার্ড করতে গিয়ে ২৮ হাজার ডুপ্লেক্স কার্ড আমরা বাতিল করেছি। এমনও পেয়েছি যে, এক ব্যক্তি নাম ঠিকানা ঘুরিয়ে তিনটি কার্ড পেয়েছে। ডিজিটাল কার্ড করতে গিয়ে এই ধোকাবাজি ধরা পড়েছে। এখন এক ব্যক্তি একটি ডিজিটাল কার্ডই পাচ্ছেন।
জেলা প্রশাসক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ বিশেষভাবে বলেন, আমরা চাই সঠিক লোকটাই সরকারের পণ্য পেয়ে উপকৃত হোক। ডিজিটাল কার্ড হোল্ডারদের মাল দিয়ে বাদ বাকি ম্যানুয়েল কার্ডধারীদের মাল ট্রাকেই বিক্রি করে দেয়া হয়। এমন অভিযোগ ভুড়ি ভুড়ি। তাই আমি ডিও দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি। প্রয়োজনে দু’তিন সময় বেশি লাগলেও সরকারি মাল প্রকৃত মানুষের হাতে তুলে দিতে চাই। এটা পবিত্র রমজান মাস। মানুষের এই পবিত্র আমানত আমরা অন্যের হাতে চলে যাক তা চাইনা। এ কারণে বলেছি, প্রতিটি ওয়ার্ড শতভাগ ডিজিটাল কার্ড না হওয়া পর্যন্ত টিসিবি পণ্য বিতরণ হবেনা। দু’একদিনের মধ্যেই আমাদের কার্ড তৈরীর কাজ শতভাগ সম্পন্ন হবে। তাই মানুষের একটু কষ্ট হবে। তবে দু’একদিন পণ্য বিতরণে দেরি হওয়ার কথা। ডিজিটাল কার্ডেই সবাই টিসিবি পণ্য পাবে। ম্যানুয়েলের দিন শেষ। ডিজিটাল কার্ডে একজন ক্রেতার সব তথ্য থাকে। ম্যানুয়েলে কারচুপি হয়। কারচুপি বন্ধেই একটু সমস্যা হল।
জনগণের হয়রানির বিষয়ে ১২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাসেম শকু বলেন, সকাল থেকে আমার ওয়ার্ডের দেড় হাজার মানুষ টিসিবি’র মালের জন্য জড়ো হয়েছে। ডিলারও ট্রাকে করে মাল নিয়ে হাজির। প্যাকেট সম্পন্ন। হঠাৎ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে নির্দেশ আসে যেনো মাল বিতরণ করা না হয়। একটা মালও বিতরণ করা হলো না। দেড় হাজার লোক সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে শুনি ডিসি সাহেব ডিও দেয়া বন্ধ রেখেছেন। যদি বন্ধই রাখা হবে তাহলে কেনো মাল দেয়ার রোস্টার করে দেয়া হয়েছিল। জনগণের সময়ের কি কোন মূল্য নেই। জনগণতো আর ডিসি অফিসে যায়না। আমরা জনপ্রতিনিধি আমাদেরকেই জবাবদিহি করতে হয়। মানুষ আমাদেরকে এসে ধরে। জবাব চায়। আমার ওয়ার্ডে দুই নাম্বারি কার্ড নাই।
এদিকে, মাসদাইর, দেওভোগ ও পাইকপাড়া এলাকার আওয়ামীলীগ নেতারা বলেন, সরকার মানুষরে কোন দাম দিতে চায় না। নাইলে এমন কাম কেমনে করলো। শয়ে শয়ে লোক লাইনে দাঁড়াইয়া ধোকা খাইলো। তিন/চার ঘণ্টা রইদে থাইক্কা অনেক রোজাদার অসুস্থ্য হইয়া গেছিলো। আমরা প্রশাসনের কাছ থেকে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। জনগণের কাছে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের ইমেজ কমে।
আপনার মতামত লিখুন :