নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের বর্তমান ও সাবেক এমপি শামীম ওসমান ৬১ বছরে পা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে তার জীবনের ৬১টি বছর। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৯৬১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জন্ম শামীম ওসমানের।
শামীম ওসমানের বাবার নাম একেএম সামসুজ্জোহা। তিনি ছিলেন ভাষা সৈনিক, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর, সাবেক গণপরিষদের সদস্য, মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত।
শামীম ওসমানের স্ত্রীর নাম সালমা ওসমান লিপি। তার এক ছেলে অয়ন ওসমান ও মেয়ে রয়েছেন। তিনি ঢাকার বারিধারায় বসবাস করেন। শামীম ওসমান প্রেম করে বিয়ে করেছেন এমন ঘটনা অনেকবার বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।
শামীম ওসমানের বড় ভাই নাসিম ওসমান ছিলেন নারায়ণগঞ্জ ৫ আসনের এমপি। ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি মৃত্যু বরণ করেন। মেঝ ভাই সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ ৫ আসনের এমপি ও বিকেএমইএ এর সভাপতি।
নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমী থেকে এসএসসি, তোলারাম কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্মাতক এবং নারায়ণগঞ্জ আইন কলেজ থেকে এল এল বি ডিগ্রি র্অজন করেন।
৮ম শ্রেণিতে পড়াশোনা অবস্থায় ছাত্র রাজনীতি দিয়ে শুরু করেন রাজনৈতিক বর্ণাঢ্য জীবন। পরর্বতীতে সরকারী তোলারাম কলেজ ছাত্রছাত্রী সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে নারায়ণগঞ্জ ৪ (ফতুল্লা-সিদ্বিরগঞ্জ) আসনে আওয়ামীলীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
শামীম ওসমান আলোচনায় আসেন ১৯৯৬ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর। যদিও এর আগে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের গাড়ি আটকে দিয়েছিলেন শামীম ওসমান। স্বৈরাচার আন্দোলনে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে রাজধানীর সড়ক প্রকম্পিত হতো। সরকারী তোলারাম কলেজের ভিপি হিসেবেও আলোচনায় ছিলেন। যখন ক্ষমতায় থাকেন তখন তিনি দোর্দান্ড দাপটে থাকেন। তবে যখন বেকায়দায় পড়েন তখন কিছুটা ব্যাকফুটে থাকেন। তবে বেকায়দার পর বার বারই কামব্যাক ঘটে শামীম ওসমানের।
১৯৯৬ হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনের এমপি ছিলেন শামীম ওসমান। ওই ৫ বছরে ঘটে নানা ঘটনা। অনুগামীরা নারায়ণগঞ্জ শহর দাবড়ে বেড়ায়। সব সেক্টর দখল করে নেয় তারা। ওই ৫ বছর ক্ষমতার সময়েই সরকারী তোলারাম কলেজে জাহানারা ইমাম ভবন উদ্বোধনের সময়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের নারায়ণগঞ্জে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। সাইনবোর্ডে সাটিয়ে দেওয়া হয় অবাঞ্ছিতের সাইনবোর্ড। শহরের ডিআইটিতে প্রতীকী জনতার আদালত বসিয়ে রাজাকারদের ফাঁসি দেওয়া হয়। প্রায় ২৬শ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেন তিনি। ক্ষমতার শেষ দিকে এসে ২০০১ সালের ১৬ জুন চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলায় আহত হন তিনি, মারা যান ২০ জন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর সংসদ নির্বাচনের পর দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয় শামীম ওসমানকে। প্রথমে পাড়ি দেন ভারতে সেখান থেকে আমেরিকা ও কানাডাতে। তছনছ হয়ে যায় সা¤্রাজ্য। সেনাপতিদেরও পালিয়ে যেতে হয় দেশ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে।
১৯৯৬ হতে ২০০১ সাল যতটা উত্থান ছিল ওই বছরের ১ অক্টোবরের পর ততটাই পতন ঘটে। দেশের বাইরে মানবেতর জীবন যাপন শুরু হয় শামীম ওসমানের। কৃষিকাজ করতে হয়েছিল এমন ছবি সম্বলিত খবরও প্রকাশ পায় পত্রিকার পাতায়। শামীম ওসমানও বিভিন্ন সময়ে বক্তব্যে এ বিষয়টি স্বীকার করেন।
দীর্ঘ ৫ বছর প্রবাসে থেকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোরব বিএনপি জামাত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হলে ২৬ ডিসেম্বর ডাক-ঢোল পিটিয়ে শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জে ফিরে আসেন। সেদিন তাকে দেওয়া হয় বিশাল সংবর্ধনা। তবে সে রাত থেকেই চাষাঢ়ায় তার বাড়িতে লোকজনদের ঢল নামে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করতে পারে এমন আশঙ্কাতে হাজার হাজার নেতাকর্মী অবস্থান করেন বাড়িতে। তবুও বেশীদিন মুক্ত বিহঙ্গনে তিনি বিচরন করতে পারেননি। ২০০৭ সালের ৭ জানুয়ারী রাতে একটি অ্যাম্ব্যুলেন্স যোগে শামীম ওসমান ঢাকায় গিয়ে আত্মগোপন করে। এক পর্যায়ে চলে যায় ভারতে। ওয়ান এলভেনের পর ২০০৭ সালের গত ১৮ ফেব্রুয়ারী গডফাদার ও দুর্র্নীতিবাজ ৫০ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেন দুর্নীতি দমন কমিশন। এই তালিকার ৯ নম্বরে ছিল শামীম ওসমান। বাতিল হওয়া ২২ জানুয়ারীর নির্বাচনেও তিনি মহাজোটের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। দুর্নীতি মামলায় ১১ বছরের সাজা ও ইন্টারপোলের হুলিয়া নিয়ে ভারতে পালিয়ে ছিলেন শামীম ওসমান। ২ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করার পর বেশ তিনি জেলার আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে দেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের পর ২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী প্রথম তাকে দেখা যায় বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে।
এমপি না হলেও তখনও ছিল শামীম ওসমানের দোর্দান্ড দাপট। তবে ওই সময়কার এমপি সারাহ বেগম কবরীর সঙ্গে দ্বৈরথ দেখা দেয় এ নেতার। প্রভাব বিস্তার নিয়ে শামীম ওসমানের বিশাল নেতাকর্মীকে ঠেকাতে বিতর্কিতদের নিয়েই মাঠে নামেন কবরী। এরই মধ্যে শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন বক্তাবলীর চেয়ারম্যান ও ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী শওকত আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পেছনে কবরীর ইঙ্গিত ও নির্দেশনা ছিল অভিযোগ ছিল। শুরু হয় কবরীর সঙ্গে শামীম ওসমানের বিরোধীত। এরই মধ্যে ২০১৩ সালে খুন হন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। অভিযোগ তোলা হয় শামীম ওসমান, ছেলে অয়ন ওসমান ও ভাতিজা আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে। শুরু হয় উত্তাপ। এরই মধ্যে শামীম ওসমান সহ ৯ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অবগতি পত্র দেন রাব্বি। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ শুরু হয়। রাব্বির পক্ষে নামেন কবরী ও সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। দেখা দেয় উত্তেজনা। এরই মধ্যে মারা যান শামীম ওসমানের বড় ভাই জাতীয় পার্টির এমপি নাসিম ওসমান। কিছুটা যখন বেকায়দায় ওসমান পরিবার তখনই জাতীয় সংসদে ওসমান পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বদলে যায় পুরো পরিস্থিতি। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর প্রাণ ফিরে পান শামীম ওসমান। ওই বছরের ২৬ জুন নাসিম ওসমানের আসেন উপ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন অপর ভাই সেলিম ওসমান। শক্তি বাড়ে পরিবারের।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী সংসদ নির্বাচনে কবরীরস্থলে মনোনয়ন পান শামীম ওসমান। নির্বাচিত হন এমপি। পাল্টে যেতে থাকে পরিস্থিতি। ২ বছর যখন সব ঠিকঠাক তখন ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে মাঠে নামেন শামীম ওসমান। আনোয়ার হোসেনকে মেয়র বানাতে উঠেপড়ে লাগে শামীম ওসমান। কিন্তু শেষতক মেয়র নির্বাচিত হন সেলিনা হায়াৎ আইভী।
সব যখন ঠিকঠাক ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারী হকার ইস্যুতে লংকাকা- ঘটে। চাষাঢ়া শামীম ওসমানের ঘোষণার পর হকার ও অনুগামীদের সঙ্গে মেয়র আইভী সহ সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। ইটপাটকেল ছোড়া হয় আইভীকে লক্ষ্য করে। হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয় তাকে। মামলার অভিযোগ করা হয় শামীম ওসমান সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
ঘনিয়ে আসে সংসদ নির্বাচন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন। মনোনয়নে বেগ পেতে না হলেও ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী মুফতি মনির হোসেন কাশেমী রীতিমত ভাবিয়ে তুলেন শামীম ওসমানকে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকাতে ছুটে চলেন তিনি। ভোট প্রার্থনা করেন। শেষতক ভোটে শামীম ওসমান জিতলেও জেলার ৫টি আসনের মধ্যে ২০ দলের প্রার্থীদের মধ্যে বেশী ভোট পান কাশেমী।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ও পরে প্রভাবশালী সংসদ সদস্য শামীম ওসমানকে নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা তখন প্রধানমন্ত্রীর একটি বার্তা নতুন করে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছেন। শামীম ওসমানকে কাছে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রাণভরে দোয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন, ‘অল থ্যাংকস টু ইউ’
২৭ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন চলাকালে ওই ঘটনা ঘটে বলে সেখানে প্রত্যক্ষদর্শী সুত্রে জানা গেলে পরে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে খোদ শামীম ওসমান নিজেই তা নিশ্চিত করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :