নারায়ণগঞ্জে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এতদিন রোগীর অবস্থা একটু খারাপ দেখলেই পাঠিয়ে দেয়া হতো ঢাকায়। কিন্তু নতুন নির্দেশনায় গুরুতর রোগী ছাড়া কাউকে ঢাকায় না পাঠানোর নির্দেশনা দেয়ায় ধারণ সংখ্যার অধিক রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। পর্যাপ্ত বেড না থাকায় হাসপাতালের ফ্লোরে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা।
মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) নারায়ণগঞ্জ শহরের ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।
হাসপাতালটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ১৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। পুরো হাসপাতালে নতুন পুরাতন মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন রোগী ভর্তি আছেন। রোগীদের জন্য বরাদ্দ ওয়ার্ড ও কেবিন মিলিয়ে ২৫টি বেড রয়েছে এই হাসপাতালে।
ভর্তি হওয়া অধিকাংশ রোগীই নারায়ণগঞ্জের বন্দর এবং সদর উপজেলার সৈয়দপুর এলাকা থেকে এসেছেন। আক্রান্তদের মধ্যে মাঝবয়সীদের সংখ্যাই বেশি। রোগীদের কাউকেই ওয়ার্ডে মশারি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। ফ্লোরে শুয়ে থাকা রোগীদের মশারি টানানোর ব্যবস্থা নেই। মাথার উপর ফ্যান না থাকায় গরমে কষ্ট পাচ্ছেন রোগীরা। অপেক্ষায় আছেন কখন একটি বেড খালি হবে।
বন্দরের ফরাজিকান্দা থেকে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আব্দুস সাত্তার (২৮)। টানা চারদিন জ্বরে ভোগার পর হাসপাতালে এসেছেন। ভর্তি হবার পর সিট পাননি, তাই ফ্লোরেই বেড বিছিয়ে শুয়ে পড়েছেন। হাসপাতালে সেবার কথা জানতে চাইতেই বললেন ‘উপরে ফ্যান নাই। কারেন্টের ব্যবস্থা থাকলে বাসা থেকে ফ্যান নিয়ে আসতে পারতাম। আর শরীরের উপর মাছি বসে অনেক বিরক্ত করে।’
সৈয়দপুর থেকে আসা পারভেজ (১৮) প্রচন্ড জ্বরে কাতরাচ্ছে। মা, নানা, নানি মিলে মুখে খাবার দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু খেতেই পারছে না পারভেজ। ডাবের পানি বোতলের মুখে ঢেলে ফোটায় ফোটায় খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন দীর্ঘ সময় ধরে। জিজ্ঞেস করতেই পারভেজের নানী বলেন, ‘অবস্থা খুবই খারাপ। নার্সরা স্যালাইন দিতাছে। কিন্তু নাতি তো খাইতেই পারে না। ডাবের পানি নিয়া আইসি, কিন্তু খাইতে পারতাছে না।’
হাসপাতালে কর্তব্যরত নার্স বলেন, ‘ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ। আজ (মঙ্গলবার) সকালেই ১৮ জন ভর্তি হলো। যারা ভর্তি হতে আসছে তারা ইমপ্রুভ হয়েই ফিরে যাচ্ছে। আমাদের যথেষ্ট সেবা এবং স্যালাইন, ওষুধ সরবরাহ হচ্ছে। যাদের ব্লিডিং হচ্ছে তাদের আমরা রেফার করছি। আর আমাদের হাসপাতালে এখন পর্যন্ত কোন রোগীর মৃত্যু নেই।’
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শেখ ফরহাদ বলেন, ‘যেহেতু আমাদের বেড সংকট তাই রোগীদের ফ্লোরে রাখতে হয়েছে। বেড খালি হলেই তাদের বেডে নিয়ে আসছি। আর রোগীর সংখ্যা এখন বাড়ছে এটা সত্য। তাদের সেবা দিতে আমাদের পর্যাপ্ত ওষুধ, স্যালাইন আছে। মূলত বেড এখন সমস্যা। নতুন করে বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার শঙ্কা আছে। সবাই সচেতন হওয়া খুবই জরুরী।’
নারায়ণগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন এএফএম মশিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের হিসেবে জেলায় এখন পর্যন্ত মোট ১ হাজার ২৪৭ জন আক্রান্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ জন। এর বাইরেও অনেকে আক্রান্ত হয়েছে যারা ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে। আমাদের তালিকা অনুযায়ী আমাদের কোন হাসপাতালেই ডেঙ্গু রোগী মারা যায়নি।’
তবে হাসপাতাল সূত্র বলছে, ‘গত তিন মাস ধরে রোগীর অবস্থা একটু গুরুতর দেখলেই রোগীদের ঢাকায় রেফার্ড করে দিতো ভিক্টোরিয়া ও খানপুর হাসপাতাল। ফলে কোন রোগী মারা গেলে তাদের নারায়ণগঞ্জ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হতো না। নতুন করে অধিক গুরুতর ছাড়া ঢাকায় রোগী না পাঠানোর নির্দেশনা আসায় স্ব স্ব হাসপাতালেই চিকিৎসা দিতে বাধ্য হচ্ছেন ডাক্তাররা।’
এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু নিধনে অব্যাহতভাবে মশার ওষুধ দিয়ে যাচ্ছে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। স্থানীয় কাউন্সিলরের সহায়তায় নিয়মিত মশার ওষুধ প্রদান করা হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের সিংহভাগই সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকার বাসিন্দা। এই চিত্র সহজেই স্পষ্ট করছে যে শহরের চাইতে শহরতলীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি।
আপনার মতামত লিখুন :