‘বাবারে আমারে একটু সময় দিলি না। একটু সময় পেলে তোরে আমি বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। আমাকে তুই মাপ করে দিস।’ বুকফাটা আর্তনাদের মত এভাবেই বিলাপ করছিলেন আবুল হাসান যাঁকে অনেকেই দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবেই চিনে জানে। সাংবাদিক এ হাসান নানা ইস্যুতে কট্টর হলেও নিজ সন্তান হারিয়ে যেন বাকরুদ্ধ। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না দ্বিতীয় ছেলের এমন প্রয়াণ। মরদেহ নিয়ে যখন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভূইগড়ের মাহমুদপুরের বাসায় তখন বড় ছেলে তাওসিফকে বুকে জড়িয়ে বার বার সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলছিলেন, ‘চেষ্টা তো করলাম বাবা। কি করবো বলো। তোমার ভাইকে আল্লাহ পছন্দ করেছে তাই নিয়ে গেছে।’
কিন্তু খেলার সাথী ছিল তাওসিফ ও তাশফিন আহনাফ। বয়সের ব্যবধান কয়েক বছরের। সে কারণেই দুইভাই ছিলেন অনেকটাই পিঠাপিটী স্বভাবের।
আবুল হাসান বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভি’র সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে কর্মরত। এক সময়ে কাজ করেছেন দিগন্ত টিভি, নয়াদিগন্ত ও নিউজ নারায়ণগঞ্জে। পরে অধিকার ও মানবকণ্ঠেও ছিলেন।
গত ১৪ জুলাই শুক্রবার আহনাফ ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আহনাফ।
এ নিয়ে মানবজমিন একটি সংবাদ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, তাশকিন আহনাফ। বয়স মাত্র সাড়ে ৬ বছর। ৩ ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। স্কুলের সহপাঠী থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্যদের মধ্যমণি ছিল আহনাফ। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত পার্ক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষিকা মা সুমাইয়া জাহান এবং বড় ভাই তাওসিফ হাসনাত সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন তাকে। আহনাফের অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার। সাড়ে ৩ বছরের ছোট বোন জাহিন নুসাইফা ভাইকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আহনাফকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে পুরো পরিবারটি। সবকিছু মাত্র ৪ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে গেল।
আবুল হাসান বলেন, আহনাফের শরীরে ডেঙ্গুর উপস্বর্গগুলো কিছুটা ছিল। প্লাটিলেট হঠাৎ করে কমে যায়। জ¦র হয়নি। কিন্তু মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ওকে নিয়ে প্রথম যখন বিএসএমএমইউতে যাই তখন দ্রুতভাবে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেয়া হয়। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করি। প্রাথমিকভাবে ওর উচ্চরক্তচাপ হচ্ছিল। অন্যদিকে রক্তের সাদা সেল বেড়ে যাওয়ার পর ডেঙ্গু টেস্ট করালে নেগেটিভ আসে। এ সময় চিকিৎসক জানান, অনেক সময় টেস্টে নেগেটিভ দেখালেও ডেঙ্গু হতে পারে। আহনাফ সে অর্থে খুব বেশি অসুস্থ ছিল না। গত মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবারও সবকিছু স্বাভাবিক ছিল ওর। খেলাধুলা করছিল। সকলের সঙ্গে কথা বলছিল। অসুস্থ বলতে হঠাৎ করে মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। এ ছাড়া কোমরের নিচে হাঁটুর বিভিন্ন অংশে সামান্য ফুলে গোলাপি রং ধারণ করে। ঢাকা মেডিকেলের পিআইসিইউতে ভর্তির পরও হাসপাতালের বিছানায় আহনাফ আমার সঙ্গে খেলছিল। এ সময় একটি কাগজ চায় ড্রয়িং করবে বলে। ওর পায়ে ব্যথা হচ্ছিল। সোজা করতে পারছিল না। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ৩টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহনাফের মৃত্যু হয়। এরআগে গত বৃহস্পতিবার দুপুর প্রায় আড়াইটায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এরপর আর জ্ঞান ফেরেনি। আহনাফের বাবা বলেন, শুরু থেকেই আমরা ডেঙ্গু হয়েছে বলে ধারণা করেছি। যদিও বিভিন্ন হাসপাতালে টেস্ট নেগেটিভ আসে।
আইসিইউতে শয্যা খালি থাকা সত্ত্বেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইসিইউ দিতে চায়নি। এরপর তাদেরকে অনেক বলার পরে শয্যা ব্যবস্থা করে। রাত প্রায় সাড়ে ৩টায় তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাই। ওর চিকিৎসা শুরু হয় সকাল সাড়ে ৭টার পরে। অর্থাৎ পুরো সময়টাতে চিকিৎসকই ছিল না। কিংবা তাদের সক্ষমতা নেই। আইসিইউতে নেয়ার পরে আহনাফকে শুধুমাত্র অক্সিজেন দিয়ে রাখে। যেটা নরমাল বেডেই দেয়া হয়। ৪ ঘণ্টা প্রায় বিনা চিকিৎসায় ছিল ছেলেটি। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেলে এ দরজা-সে দরজা করতে করতে প্রায় ১০টি দরজায় ঘুরতে হয়েছে আমাকে। দশ জনের স্বাক্ষর আনতে গিয়ে অসুস্থ ছেলেকে রেখে হাসপাতালে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আমার ছেলেটা মারা যেতে পারতো। আমাদের এই চিকিৎসা ব্যবস্থার আসলে পরিবর্তন হওয়া দরকার। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থাটা কমে যাচ্ছে। সকল কিছু এক স্থানে হওয়া উচিত। ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’ হলে এত ভোগান্তি পোহাতে হতো না। একজন রোগীকে যখন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয় তখন স্বজনরা কিন্তু জানে না আদৌ অন্য হাসপাতালে সিট ফাঁকা আছে কিনা। রোগীকে ভর্তি করতে পারবে তো। রোগীটা বাঁচবে কিনা সে চিন্তা কিন্তু তারা করে না।
আপনার মতামত লিখুন :