News Narayanganj
Bongosoft Ltd.
ঢাকা শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

চাষাঢ়ায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক জনসভা


দ্যা নিউজ নারায়ণগঞ্জ ডটকম | এস এম শহিদুল্লাহ (লেখক ও গবেষক) : প্রকাশিত: মে ৮, ২০২৩, ১১:০২ পিএম চাষাঢ়ায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক জনসভা

ছয় দফাকে বলা হয়ে থাকে বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয় দফা আন্দোলনে স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। ছয় দফার পক্ষে গণজাগরণের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশব্যাপী জনসভা করেন। তিনি ২০ মার্চ থেকে ৮ মের মধ্যে ৫০ দিনে ৩২টি জনসভায় ভাষণ দেন। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ টাউন হল মাঠে (বর্তমান এখানে শহীদ জিয়া হল প্রতিষ্ঠিত) ১৯৬৬ সালের ৮ মে বিরাট জনসভায় তিনি একটি ভাষণ দেন। সেটি সংবাদপত্র থেকে উদ্ধৃত করা হলো:

দলে দলে কারাবরণের এই প্রস্তুতির মুখে দশ কোটি মানুষের এ মুক্তি সংগ্রাম প্রতিরোধের ক্ষমতা কাহারও নাই নারায়ণগঞ্জের অভূতপূর্ব জনসমাবেশে শেখ মুজিবের ঘোষণা ‘সংগ্রামী নেতার’ প্রতি শহরবাসীর শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ স্বর্ণনির্মিত প্রতীক উপহার দান

‘শক্তিশালী কেন্দ্র নয় শক্তিশালী পাকিস্তানই আমাদের কাম্য। তাই মুক্তি সনদ হিসাবে ৬-দফা দাবী পেশ করা হইয়াছে। আর এই দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কোন কিছুই আমাদের সংকল্প হইতে বিচ্যুত করিতে পারিবে না। গতকাল (রবিবার) নারায়ণগঞ্জ টাউন হল ময়দানে নয়নাভিরাম ও সুশৃংখল পরিবেশে অনুষ্ঠিত স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমুদ্রকে লক্ষ করিয়া আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তেজদৃপ্ত কন্ঠে উক্ত ঘোষণা করেন। গতকাল নারায়ণগঞ্জের জনসভায় সর্বপ্রথম ৬-দফার প্রণেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাঁচ কোটির নহে দশ কোটি জনগণের নেতা বলিয়া ঘোষণা করা হয়। এই উপলক্ষে জনসাধারণের শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি আওয়ামী লীগ কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে ৬-দফা খোদিত একটি স্বর্ণ তারকায় ভূষিত করা হয়। সভায় আদমজী শ্রমিকদের পক্ষ হইতে শেখ মুজিবকে পাটের তৈরি মালায় ভূষিত করা হয়। বস্ত্রমিল শ্রমিকদের পক্ষ হইতে আওয়ামী লীগ প্রধানকে মাল্য ভূষিত করা হয়। ইহাছাড়া পাট ব্যবসায়ী, সিটি আওয়ামী লীগ এবং জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতেও তাঁহাকে মাল্যভূষিত করা হয়। ৬-দফার প্রতীক হিসাবে শেখ মুজিব ৬টি শান্তি কপোত উড়াইয়া দেন। সভাশেষে ৬-দফার প্রতীক হিসাবে ৫টি মশাল জ্বালাইয়া সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করা হয়।

গতকাল জনতার অনুরোধে নির্ধারিত সময়ের অর্ধঘন্টা পূর্বেই সভার কাজ শুরু করিতে হয় এবং রাত ৮টা পর্যন্ত সভার কাজ চলে। ৬-দফা দাবী আদায়ের অগ্নিশপথ গ্রহণ করার জন্য আদমজী জুট মিলের প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক মিছিল সহকারে সভায় আগমন করে। ইহাছাড়া শীতলক্ষ্যা, নলুয়া, পাইকপাড়া, দেওভোগ, হাজীগঞ্জ ইউনিয়ন হইতে এবং বিভিন্ন মহল্লা হইতে মিছিল সহকারে জনতা সভায় যোগদান করে। এই সকল মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের হাতে ৬-দফা দাবীর সমর্থনে ও অন্যান্য দাবী-দাওয়া সম্বলিত বিভিন্ন ফেষ্টুন শোভা পাইতেছিল। সন্ধ্যা প্রায় ৭টার সময় বিড়ি শিল্পের শ্রমিক ও মালিকদের একটি মিছিল আসিয়া সভায় শামিল হয়। মুহর্মুহু করতালির মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, শক্তিশালী, সুখী, সমৃদ্ধশালী ও গণতান্ত্রিক পাকিস্তান সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই আমাদের বাঁচার দাবী ৬-দফা পেশ করি। কিন্তু আমাদের বিদেশীর চর এবং পাকিস্তানের ধ্বংসকামী বলিয়া আখ্যায়িত করা হইতেছে। কিন্তু এসব আখ্যা আমাদের কাছে নূতন নয়।

পাকিস্তানের ভিত্তি লাহোর প্রস্তাবের প্রণেতা শেরেবাংলা এবং পাকিস্তানের অন্যতম ¯্রষ্টা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও উক্ত আখ্যায় আখ্যায়িত হইয়া পৃথিবী হইতে বিদায় নিতে হইয়াছে। সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিপুল জনতাকে লক্ষ করিয়া শেখ মুজিব এক এক করিয়া ৬-দফা কর্মসূচীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান করিয়া তুমুল করতালির মধ্যে ঘোষণা করেন, ৬-দফা দাবী উত্থাপনের পর হইতে নূতনভাবে আমার বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা দায়ের করা হইতেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের জানিয়া রাখা দরকার যে, কোন কিছুতেই আমাদের ৬-দফা আদায়ের প্রতিজ্ঞা হইতে বিচ্যুত করা যাইবে না। নিবিষ্টচিত্ত শ্রোতাদের লক্ষ্য করিয়া আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, আওয়ামী লীগের ১৪ শত কর্মী ৬-দফা আদায়ের জন্য কারাভোগসহ যে কোন ত্যাগ স্বীকারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিয়াছেন। এ সময় জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রয়োজন বোধে আপনারাও কারাভোগে প্রস্তুত আছেন কি? সঙ্গে সঙ্গে একযোগে লক্ষ হস্ত উত্তোলন করিয়া জনতা কারাভোগের প্রস্তুতির শপথ গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব খাদ্যসহ বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া বলেন যে, বাধ্যতামূলক লেভী করা হইয়াছে, তাই সার্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থাাও প্রবর্তন করা উচিত ছিল। তিনি বলেন যে, লেভী করিয়া সরকারী গুদামে ধান-চাউল জমা করা হইয়াছে বলিয়া আজ বাজারে ধান-চাউলের অভাব দেখা দিয়াছে। তিনি অনতিবিলম্বে মোকাবিলা করিয়া দুর্দশাপীড়িত মানুষকে রক্ষা করার দাবী জানান।

৬-দফার সমালোচকদের লক্ষ্য করিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, ৬-দফায় শ্রমিক-কৃষকদের কথা নেই, এই সকল সমালোচকদের জানাইয়া দিতে চাই যে, আওয়ামী লীগের কর্মসূচী দেখুন। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। অতএব, তাহাদের ঐসব সমালোচনা অর্থহীণ। কেননা সমাজতন্ত্রে মধ্যেই দেশের শ্রমিক-কৃষকদের সমস্যার সমাধান নিহিত আছে।

স্থাানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম শামসুজ্জোহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত জনসভায় পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক সর্বজনাব জহীরুদ্দিন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল হোসেনও বক্তব্য রাখেন।

শেখ মুজিব গ্রেফতার : ৮ মে (১৯৬৬) রাতে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোস্তাক আহমদকে দেশ রক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়াও দলের প্রায় ৩৫০০ নেতা-কর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়। সে কথা সংবাদপত্র থেকে উদ্ধৃত করা হলো:

শেখ মুজিব তাজুদ্দীন ও মুস্তাক গ্রেফতার : (ষ্টাফ রিপোর্টার) গতরাত (রবিবার দিবাগত) ২টার দিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান, সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজুদ্দীন আহমদ ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মুশতাক আহমদকে গ্রেফতার করা হইয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। পুলিস তিনজন নেতার গৃহেই যুগপৎভাবে হানা দেয়। তাঁহাদিগকে পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধি অনুযায়ী গ্রেফতার করা হইয়াছে বলিয়া প্রকাশ। (‘নারায়ণগঞ্জের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থ’ থেকে সংকলিত)

Islams Group
Islam's Group