১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতার ঘোষণার পরদিন ২৭ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী সমরাস্ত্র নিয়ে নারায়ণগঞ্জে প্রবেশের সময়ে সদর উপজেলার ফতুল্লার মাসদাইর এলাকায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল বাধাঁর সম্মুখীন হয়ে পিছু হটে। প্রায় ২৪ ঘণ্টারও বেশী সময় ধরে প্রতিরোধের কারণে শহরে প্রবেশে ব্যর্থ হয় পাক বাহিনী। এসময় পাক বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধে দুই পাক হানাদার সহ ১০-১২ জন মারা যায়। এটাই দেশের প্রথম সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
জানাগেছে, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় নিরীহ জনতাকে হত্যার খবরটি দ্রুতই পৌঁছে যায় নারায়ণগঞ্জে। ২৬ মার্চ সকাল থেকে ২৭ মার্চ দুপুর পর্যন্ত সমগ্র শহর আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। সবার মাঝেই বদ্ধমূল ধারণা ঢাকার পরই পাকবাহিনী নারায়ণগঞ্জে আক্রমণ চালাবে। এটা ভেবে বহু পরিবার শহর ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। তবে ভীত না হয়ে পাকবাহিনীকে ঠেকিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। তাঁরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নেতারা ফতুল্লা, পঞ্চবটি এলাকার স্থানীয় নেতাদের নির্দেশ দেয় পথে গাছ কেটে ফেলে রেখে দেওয়ার জন্য। বীর জনতা নেতাদের নির্দেশ সেদিন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। এছাড়াও স্টেশন থেকে ওয়াগন এনে চাষাঢ়া রেল গেট, ২নং রেল গেট এলাকায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছিল।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে প্রতিরোধের অন্যতম সমন্বয়ক শফিউদ্দিন সারোয়ার ওরফে বাবু সারোয়ার নিউজ নারায়ণগঞ্জকে জানান, মূলত: ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পরই আমরা জোহা ভাইয়ের দিক নির্দেশনায় কাজ করে যাচ্ছিলাম। ২৭ মার্চ সকাল ১০ টার মধ্যেই খবর পৌছে যায় পাক বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সামরিক যানসহ নারায়ণগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আসার পথে তারা টিকাটুলি থেকে অজস্র ধারায় গুলি বর্ষণ করে আসছিল। পথে তারা ফতুল্লা ও পঞ্চবটিতে পাকবাহিনী বাধার মুখে পড়ে।
বাবু সারোয়ার নিউজ নারায়ণগঞ্জকে জানান, আমরা সাবেক ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সিরাজ ভাইয়ের নেতৃত্বে অস্ত্রগার লুট করে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। তিনি জানান, ছাত্র কর্মীদের একটি দল অবস্থান নিয়েছিল মাসদাইর খায়ের সাহেবের বাড়ির পশ্চিম দিকে কয়েকটি বাড়ি ও উঁচু জায়গায়। অপর একটি গ্রুপ অবস্থান নেয় মাসদাইর শ্মশান ও কবরস্থানে। তৃতীয় আরেকটি গ্রুপ ছিল চানমারী এলাকায়। পাক বাহিনী ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ ঢুকার চেষ্টা করলে প্রতিহত করার দায়িত্ব ছিল তাদের উপর।
সেদিন সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে আলোচনা করে জানা গেছে, পাকবাহিনী নারায়ণগঞ্জে প্রবেশের মুখেই মাসদাইর কবরস্থান এলাকায় প্রবল বাধার মুখে পড়ে। স্বাধীনতাকামী ছাত্র জনতার সাথে শুরু হয় তাদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। ছাত্রদের গুলির আঘাতে এক পাক সেনা নিহত হয় সেদিন। এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকবাহিনীকে মাসদাইর এলাকায় ঠেকিয়ে রাখে নারায়ণগঞ্জের সাহসী যোদ্ধারা। পরে পাকবাহিনী আরও ভারী অস্ত্র নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। এরই মাঝে প্রতিরোধকারীদের গুলি ফুরিয়ে গেলে তারা পিছু হটে। শহরে ঢুকার মুহুর্তে হানাদার পাকবাহিনী নিরীহ জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে প্রায় ৫০ জনকে হত্যা করে।
প্রায় ২৪ ঘণ্টারও বেশী সময় প্রতিরোধ সৃষ্টির পর ২৮ মার্চে পাক হানাদার বাহিনী অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে দ্বিতীয় দফায় প্রবেশ করে। সেদিন তৌফিক সাত্তার, ইট ব্যবসায়ী আবদুল সাত্তার, ব্যাংকার সাত্তার, ব্যবসায়ী জসীমুল হক এবং তার সহ ধর্মীনি সহ অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে ২০জনের নাম এখন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তালিকায় রয়েছে।
জানা গেছে, মাসদাইর প্রতিরোধ যুদ্ধে ওই সময়ে আরো যাঁরা সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে কমা-ার সিরাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী, আবদুস সাত্তার মরণ, খোরশেদ আলম দুদু, তমিজউদ্দিন রিজভী, ননী সারোয়ার জাহাঙ্গীর খোকা, আশরাফ, আমিনুল ইসলাম, ফজলুল হক প্রমুখ।
নারায়ণগঞ্জবাসী এ প্রতিরোধকে দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ ভেবে গর্ববোধ করে। যে জায়গাটিতে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছিল সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে প্রতিরোধ স্তম্ভ। কিন্ত অযতœ অবহেলা আর দখলদারদের কারণে স্তম্ভের প্রকৃত সৌন্দর্য্য এখন ম্রিয়মান।
মুক্তিযোদ্ধা মোহর আলী চৌধুরী জানান, ২৬ মার্চ দুপুর থেকে মাসদাইর কবরস্থান ও শ্মশান এলাকায়ঃ সিরাজুল ইসলাম, শফিউদ্দিন সারোয়ার বাবু, আব্দুস সাত্তার মরণ, খোরশেদ আলম দুদু, মীর শহীদুল্লাহ, জয়নাল আবেদীন টুলু, মনসুর আহাম্মদ, মোঃ সামসুদ্দিন, আজহার হোসেন ও সাংবাদিক কামরুজ্জামান এর নেতৃত্বে অসংখ্য সংগ্রামী জনতা মাসদাইর জামতলা রাস্তার পশ্চিম ও দক্ষিণ পার্শ্বে ঃ আব্দুস সাত্তার, মোঃ জানে আলম, শরীফুল আশরাফ, সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ, মোহর আলী চৌধুরী, আঃ আউয়াল মিলন মুন্সীগঞ্জের ছাত্রনেতা মোঃ আনিস ও মোঃ বাবুলের নেতৃত্বে অসংখ্য সংগ্রামী জনতা তোলারাম কলেজ সংলগ্ন চাষাঢ়া কুন্ডবাড়ী এলাকায়ঃ মোঃ মনিরুল ইসলাম, ফয়েজুর রহমান, মোঃ শাহ্জাহান, এম.এ. আউয়াল, মোঃ ওবায়েদউল্লাহ, আব্দুল মোতালিব, শরফুদ্দিন রবি, খবির আহম্মেদ, আঃ রাশেদ, সামছুল ইসলাম ভূঞা, তমিজউদ্দিন রিজভী, এনায়েত উল্লাহ, আঃ গফুর, নূর উদ্দিন আহমেদ, শহিদ বাঙ্গালী ও আব্দুল হামিদ পোকন এর নেতৃত্বে, অবসর ও ছুটিতে থাকা সেনা, ইপিআর, পুলিশ এবং আনসার সদস্যসহ অসংখ্য ছাত্র নেতা, কর্মী ও আশে পাশের সাহসী জনতা তীর-ধনুক, বল্লমসহ উল্লেখিত তিনভাগে পাক হানাদার বাহিনীকে নারায়ণগঞ্জ প্রবেশে প্রতিরোধ করার জন্য সশস্ত্র অবস্থান গ্রহন করে। কাঁদতে কাঁদতে ঢাকা থেকে আসা অসংখ্য মানুষ জানায় গত রাত থেকে পাকবাহিনী ঢাকা ইউনিভার্সিটির হলসমূহে, ই.পি.আর হেড কোয়ার্টার পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ ঢাকা শহরে হাজার হাজার মানুষকে পাখির মত গুলি করে হত্যা, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ ও লুটপাট করছে। ঢাকা শহরে লাখ লাখ নারী-পুরুষ, শিশু ভয়ে যে-যেভাবে পারছে গ্রামের দিকে ছুটে যাচ্ছে। ঢাকায় পাকবাহিনীর আক্রমণের বর্বরতা শুনে নারায়ণগঞ্জ শহরবাসী শহর ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা রাতেই জানা গেল পাক বাহিনী ঢাকা থেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পোস্তগোলা দিয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে আসার পথে পাকবাহিনী রাস্তার ব্যারিকেড অপসারণ করছে, ওদের ভাষায় বাঙ্গালীদের অকথ্য গালিগালাজ করছে, এলোপাতাড়ি ব্রাশ ফায়ার করে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করছে এবং আশপাশের বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ করছে। ২৭ মার্চ সকালের মধ্যে পাকবাহিনী ফতুল্লায় এসে পৌঁছেছে এ খবর নারায়ণগঞ্জে প্রতিরোধ বাহিনীর নিকট দ্রুত গতিতে চলে আসে। প্রতিরোধ বাহিনীও প্রস্তুত। প্রথমে একটি সাদা ট্যাক্সি এবং পেছনে একটি সামরিক যানে করে ধীরগতিতে পাকবাহিনী নারায়ণগঞ্জ প্রবেশের সূচনা করে। পাকবাহিনী নারায়ণগঞ্জ পঞ্চবটি সড়কে শ্মশানের পশ্চিমে ব্রীজের উপর আসতেই প্রতিরোধ বাহিনীর রাইফেল, বন্দুক, পিস্তল ও বোতল ককটেল গর্জে উঠে। পাকবাহিনী মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি থেকে লাফিয়ে রাস্তায় শুয়ে বৃষ্টির মত মেশিনগানের গুলি ও ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। ক্ষনিকের মধ্যে পাক বাহিনীর সাথে যুক্ত হয় ভারী অস্ত্র সহ আরো অনেক সৈন্য। বিশ্বের সেরা পাক বাহিনীর সাথে আমাদের প্রতিরোধ বাহিনী রাইফেল, বন্দুক, পিস্তল ও বোতল ককটেল দিয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে ২৭ মার্চ সকাল ১০ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় সাত্তার জুট মিল মালিকের ছেলে তৌহিদ এবং জামতলা নিবাসী ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার, তার ড্রাইভার ও ড্রাইভারের ভাই এবং আহত হয় ছাত্রনেতা খোরশেদ আলম দুদুসহ অনেকেই। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এই প্রতিরোধের ফলে নারায়ণগঞ্জের অধিকাংশ নারী, পুরুষ, শিশু তাড়াহুড়া ও ছুটাছুটির মাধ্যমে আশপাশের এলাকায় নিরাপদে চলে যেতে সক্ষম হয়। এভাবেই আবারও ইতিহাস সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ৭১ এর অসহযোগ এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে নারায়ণগঞ্জবাসী। পরবর্তীতে শুরু হয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বাঙালীর মহান স্বাধীনতার বিজয়।
আপনার মতামত লিখুন :