ফতুল্লার লামাপাড়া মোড়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দোকানের কথা জিজ্ঞাস করতেই এক তরুণ বলে উঠেন ‘কোন আকাশ? ল্যাম্বরগিনি বানাইসিলো ওই আকাশ?’ হ্যা সূচক উত্তর পেতেই দেখিয়ে দেয় ইজিবাইক মেরামতের ওয়ার্শকপটি। ভেতরে কাজ করছিলেন আকাশের বাবা নবী হোসেন। প্রতিবেদককে একনজর দেখেই হাসিমুখে চিনে ফেললেন তিনি। এই ওয়ার্কশপে বসেই তার ছেলে ল্যাম্বরগিনির আদলে গাড়ি তৈরি করে সাড়া ফেলেছিলেন দেশ বিদেশে।
২০১৯ সালের জুন মাসে ইতালির ল্যাম্বরগিনির আদলে গাড়ি তৈরি করে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন আকাশ আহমেদ। কোন পুরোনো গাড়ি মডিফিকেশন বা আমদানি করে নয়। কেবলমাত্র ইউটিউবের সহযোগিতায় নিজের হাতেই পুরোপুরি গাড়ি নির্মাণ করেন আকাশ। গাড়ির চেসিস থেকে শুরু করে বডি, সাসপেনশন, গ্লাস, লাইট, গিয়ার সবকিছুই ছিল আকাশের নিজের হাতের তৈরি। বাবার ইজিবাইকের ওয়ার্কশপে কাজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই দীর্ঘ দেড় বছরের প্রচেষ্টায় গাড়ি নির্মাণে সক্ষম হন। ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহার করেন পরিবেশ বান্ধব ইলেক্ট্রিক মোটর। দেশীয় প্রযুক্তির সহায়তায় ল্যাম্বরগিনির আদলে ই-কার তৈরি করে আলোচনায় চলে আসেন তিনি। এক নামে পরিচিতি পায় ‘ল্যাম্বরগিনি আকাশ’।
গাড়ি নিয়ে আলোচনায় আসার পরপরেই ইউরোপ, কানাডা ও ভারতের বেশকয়েকটি গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ হয় আকাশের। করোনার পূর্বে ভারতের একটি জনপ্রিয় গাড়ি কোম্পানির সাথে প্রায় চুক্তি হয়েই গিয়েছিল। কিন্তু লকডাউন শুরু হবার পর থমকে যায় সেই প্রক্রিয়া। করোনার প্রকোপ শেষ হবার পর আর সাড়া মেলেনি তাদের কাছ থেকে। এছাড়া ২০১৯ সালে ডিজিটাল ডিভাইস ও ইনোভেশন এক্সপো প্রদর্শনীতে স্থান পায় আকাশের গাড়িটি। সেসময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার গাড়িটি দেখে প্রশংসা করেন এবং তাকে নিয়ে কাজ করার আশ্বাস দেন। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন মাধ্যমেই আসেনি সহায়তা কিংবা উদ্যোগ। ফলে কিছুটা হতাশ হয়ে আবারও নিজের পুরোনো ইজিবাইকের ওয়ার্কশপেই মনযোগ দিয়েছিলেন আকাশ।
গাড়ি নির্মাণ পরবর্তী অবস্থা নিয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় আকাশের। আলাপচারিতায় আকাশ জানান, দীর্ঘ বিরতিতেও বসে ছিলেন না তিনি। নিজের চলাফেরার জন্য ইতোমধ্যে তৈরি করেছেন ১৫০ সিসির একটি মোটরসাইকেল। সম্পূর্ণ ডিজাইন এবং নির্মাণ করেছেন নিজেই। কেবল ইঞ্জিন নিয়ে এসেছেন দেশের বাইরে থেকে। গাড়ির পর মোটরসাইকেলটি নিজ এলাকায় বেশ আলোচনা তৈরি করলেও আকাশ চান গাড়ি নিয়েই কাজ করতে। মোটরসাইকেল নিয়ে ততটা আগ্রহ জন্মেনি তার ভেতর।
আকাশ বলেন, ‘মাত্র দেড় মাস আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ শুরু করেছি। সেখানে ই-কার তৈরি ও ডিজাইনের কাজ করছি। প্রতিষ্ঠানটির ইচ্ছা আছে আগামীতে বাংলাদেশে দেশীয় ই-কার বাজারজাত করবে। তবে পুরো বিষয়টিই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এর আগ পর্যন্ত আমি আমার বাবার ওয়ার্কশপেই কাজ করেছি।’
নতুন কোন গাড়ির কাজ করছেন কিনা এমন প্রশ্নে বলেন, ‘ল্যাম্বরগিনি গাড়িটা এখন গ্যারেজে ফেলে রেখেছি। নতুন করে ক্যাম্পাগানা টি রেক্স গাড়ির আদলে তিন চাকার একটি গাড়ির কাজ চলছে। এর পেছনেও প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার মত খরচ হয়েছে। আশা করছি কিছুদিন পরেই সেটা উদ্বোধন করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম প্রায় ৪০ লাখ টাকার মত, আর দেশের মার্কেটে মোটামুটি সাত লাখ টাকার মধ্যে বিক্রি করা যাবে। দেশের রাস্তায় ব্যাটারি চালিত গাড়ি ততটা গতিশীল নয়, সেজন্য এবারের গাড়ির জ্বালানি তেলে চালনার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’
গাড়ি তৈরির পর অনেক আশ্বাস পেলেও তার বাস্তবায়ন পাননি এমন আক্ষেপ নিয়ে আকাশ বলেন, আমি সবচেয়ে বেশি পেয়েছি মানুষের প্রতিশ্রুতি, এর বাস্তবায়ন পাইনি বললেই চলে। অথচ শুরুর দিকে ২৫টি ল্যাম্বরগিনির আদলে গাড়ি তৈরির অফার আসলেও সেগুলোবাতিল করেছি। আমাকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল আমাকে নিয়ে তাঁরা কাজ করবে। কিন্তু পরে আমাকে আর ডাকা হয়নি। বর্তমানে দেশ যেই পরিমাণ এগিয়েছে তাতে দেশে ইঞ্জিন তৈরিসহ গাড়ি নির্মাণ করা কোন বিষয়ই না। যদি সরকারি উদ্যোগ বা বেসরকারি অর্থায়ন পাওয়া যায়, তাহলে বাণিজ্যিকভাবে গাড়ি নির্মাণ করা যাবে। মানুষ পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকায় ভালো গাড়ি পাবে। আমি উদ্যোগ এককভাবে নিতে পারছি না কেবল আর্থিক জোগান নেই বলে।’
বিদেশি গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে অফার পেয়ে কেন যাওয়া হয়নি এমন প্রশ্নে আকাশ বলেন, ‘প্রথমত ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রথমে কথা চললেও লকডাউনের পরে আর তাঁরা যোগাযোগ করেনি। আর ইউরোপ কানাডায় বাবা যেতে নিষেধ করেছে। তাই দেশেই কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার ইচ্ছা সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে যুক্ত হয়ে দেশেই গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। যেখানে আমার মত অনেক গাড়ি নির্মাতা কাজের সুযোগ পাবে এবং তাঁরা তাদের প্রতিভা ফুটিয়ে তুলতে পারবে।’
গাড়ি বানিয়ে আলোচনায় আসা আকাশের গর্বিত বাবা নবী হোসেন বলেন, ‘ছেলের কারণে সবাই প্রশংসা করে এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া। শুরুর দিকে তো অনেক কাজের অফার আসছিল, এখন আর অত আগ্রহ দেখি না কোম্পানির মানুষের কাছে। আকাশ চায় অনেক কিছু করতে, যদি সরকার ওর কাজ দেইখা যদি মনে করে ভালো কাজ করছে, তাইলে যেন ওরে ঠিকমত কাজে লাগায়। এর বেশি কিছু চাই না আমরা।’
আপনার মতামত লিখুন :