News Narayanganj
Bongosoft Ltd.
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩, ১৬ চৈত্র ১৪২৯

১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা’ আ‌ন্দোল‌নে নারায়ণগঞ্জের অবদান


দ্যা নিউজ নারায়ণগঞ্জ ডটকম | এস এম শ‌হিদুল্লাহ : প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২৩, ১০:২৬ পিএম ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা’ আ‌ন্দোল‌নে নারায়ণগঞ্জের অবদান

১১ মার্চ এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে এ‌দে‌শে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই-এর দা‌বি‌তে ও এদেশের প্রথম সফল হরতাল। ১১ মার্চের পথ ধরেই পরবর্তীকালে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিকশিত হয়।

১১ মার্চের ধর্মঘট সফল করার লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জের ছাত্রসমাজ বিপুলভাবে সাড়া দেয়। বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ধর্মঘট করে শোভাযাত্রাসহকারে সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করে। তৎকালীন ছাত্রনেতা একেএম শামসুজ্জোহা, বজলুর রহমান, বদরুজ্জামান, মফিজউদ্দিন, হাবিবুর রশিদ, সুলতান মাহমুদ মল্লিক, কাজী মজিবর, শেখ মিজান প্রমুখের নেতৃত্বে একদল ছাত্রকর্মী তখনকার ফুড অফিসে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং হরতাল পালনের জন্য বিভিন্ন শ্লোগান দেয় (তখন ফুড অ‌ফিসগু‌লো ছিল প্রশাস‌নের প্রভাবশালী কার্যালয়)। ছাত্রদের এ বিক্ষোভের সংবাদ পেয়ে পুলিশ এসে তাদের হটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। খবর পেয়ে খান সাহেব ওসমান আলী এবং আলমাছ আলী সেখানে ছুটে যান। বেশ কিছুক্ষণ বিক্ষোভ চলার পর কর্মচারীরা অফিস পরিত্যাগ করলে ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের জনসাধারণ এবং ছাত্রসমাজ এক অনন্য ভূমিকা পালন করে।

১৯৫২ সা‌লের ৩১ জানুয়া‌রি মাওলানা ভাসানী‌র সভাপ‌তি‌ত্বে এক সভায় ৪০ সদস্য বি‌শিষ্ট ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গ‌ঠিত হয়। ফেব্রুয়ারির প্রথম‌দি‌কে নারায়ণগ‌ঞ্জেও ম‌ফিজউ‌দ্দিন আহাম্মদ ও আজগর হো‌সেন ভূঁইয়া‌কে যুগ্ম আহ্বায়ক ক‌রে অনুরূপ ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম প‌রিষদ’ গ‌ঠিত হয়।

তৎকালীন পূর্ব পা‌কিস্তা‌নে বাংলা‌কে রাষ্ট্রভাষা করার দা‌বি‌তে ১৯৫২ সা‌লের ২১ ফেব্রুয়া‌রি নারায়ণগ‌ঞ্জের ছাত্রসমাজের উদ্যোগে সমস্ত শিক্ষা প্র‌তিষ্ঠা‌নে পূর্ণ ধর্মঘট পা‌লিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট পালনের পর বি‌কে‌লে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম প‌রিষদের উ‌দ্যো‌গে রহমতউল্লাহ ক্লা‌ব প্রাঙ্গ‌নে আ‌লোচনা সভা অনু‌ষ্ঠিত হয়। সমা‌বে‌শে প্রধান অ‌তি‌থি ছি‌লেন অ‌বিভক্ত বাংলার মুস‌লিম লী‌গের সাধারণ সম্পাদক আবুল হা‌সিম। সেই সভায় বক্তব্য দেন আলমাছ আলী (বড়), বজলুর রহমান, মোস্তফা সা‌রোয়ার প্রমুখ।

সভা চলাকা‌লে ঢাকায় পু‌লি‌শের গু‌লি চালা‌নোর খবর ও বহু‌লোক শহীদ হওয়ার খবর আ‌সে। গু‌লিতে সালাম, বরকত, র‌ফিক, জব্বার ও শ‌ফিউরসহ আরও অ‌নে‌কে শহীদ হন। এ খব‌রে আ‌লোচনা সভা বিক্ষো‌ভে ফে‌টে প‌ড়ে। তখনই এক বিরাট মি‌ছিল বের করা হয়। মুহূ‌র্তে শহর উত্তপ্ত হ‌য়ে ও‌ঠে। মি‌ছিল‌টি শহর প্রদ‌ক্ষিণ ক‌রে।

প‌রের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ গণআ‌ন্দোল‌নে অন্য একরূপ ধারণ ক‌রে। পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতা‌বেক বিকে‌লে চাষাঢ়া মা‌ঠে (বর্তমা‌ন এখা‌নে তোলারাম ক‌লেজ অব‌স্থিত) প্রখ্যাত শ্র‌মিক নেতা ফ‌য়েজ আহাম্মদের সভাপ‌তি‌ত্বে এক বিরাট প্র‌তিবাদ সভা অনু‌ষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার শ্র‌মিক সে সভায় যোগদান ক‌রে। সে‌দিন ঢাকা-নারায়ণগ‌ঞ্জ রেল চলাচল বন্ধ থা‌কে। সভা শুরুর পূর্বে‌ মর্গ্যান স্কু‌লের প্রধান শিক্ষ‌য়িত্রী মমতাজ বেগমের নেতৃ‌ত্বে এক‌টি ম‌হিলা দলও শোভায‌াত্রা সহকা‌রে সভায় যোগদান করেছিল। প্র‌তিবাদ সভা শে‌ষে এক বিরাট মি‌ছিল শহর প্রদ‌ক্ষিণ ক‌রে। মি‌ছি‌লে শহর হ‌য়ে ওঠে মুখ‌রিত। সবার মু‌খে একই স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘খু‌নি নূরুল আমী‌নের ফাঁ‌সি চাই’ ‘ডি এম কো‌রেশীর রক্ত চাই’।

উ‌ল্লেখ্য, এম এইচ কো‌রেশী ছি‌লেন তখন ঢাকার জেলা ম্যা‌জি‌স্ট্রেট। তার নি‌র্দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মি‌ছি‌লে পু‌লি‌শের গুলি‌তে বরকত, র‌ফিক শহীদ ও অ‌নেক লোক আহত হ‌য়ে‌ছি‌লেন। প‌রের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি করা‌চি থে‌কে প্রকা‌শিত দৈ‌নিক ‘ই‌ভি‌নিং টাইমস’ সংবা‌দপ‌ত্র শি‌রোনাম ক‌রেছিল ‘নূরুল আ‌মিন মাস্ট গো নারায়ণগ‌ঞ্জ মি‌টিং ডিমান্ড’।

মুস‌লিম লীগ সরকার দূর‌ভিসন্ধিমূলকভা‌বে মমতাজ বেগ‌মের বিরূ‌দ্ধে মর্গ্যান স্কু‌লের তহ‌বিল তছরুপের অভি‌যোগ এ‌নে ২৯ ফেব্রুয়ারি সকা‌লে তাঁ‌কে সাস‌পেন্ড ও গ্রেফতার ক‌রে। গ্রেফতা‌রের প্র‌তিবা‌দে ছাত্র-ছাত্রী ও জনতার বি‌ক্ষো‌ভের কার‌ণে প্রশাসন মমতাজ বেগম‌কে পু‌লিশ ভ্যা‌নে ক‌রে ঢাকায় পা‌ঠি‌য়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়। ঢাকায় যাওয়ার প‌থে চাষাঢ়ার মো‌ড়ে ছাত্র-জনতা মমতাজ বেগম‌কে বহনকারী ভ্যান‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে ইট-পাট‌কেল ছু‌ড়তে থা‌কে। জনতা বনাম পু‌লি‌শের ম‌ধ্যে চল‌তে থা‌কে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। ইপিআর বা‌হিনী রাই‌ফে‌লের বাট দি‌য়ে জনতা‌কে এ‌লোপাতা‌ড়ি মার‌তে থা‌কে। এ পর্যা‌য়ে এ স্থান থেকেও বেশ ক‌য়েকজন‌কে গ্রেফতার ক‌রে। প্রশাসন রা‌তে শহ‌রে ১৪৪ ধারা জা‌রি ক‌রে।

নারায়ণগ‌ঞ্জের প‌রি‌স্থি‌তি এতই খারাপ হয় যে, শে‌ষে ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত থে‌কে শহ‌রে একটানা ৩০ ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন জা‌রি ক‌রে এবং ভাষা আ‌ন্দোল‌নের অ‌নেক কর্মী‌কে গ্রেফতার ক‌রে। ২৯ ফেব্রুয়ারি‌তে আটককৃত ব্য‌ক্তিগণ‌কে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগা‌রে আটকে রা‌খে। প্রায় দেড় দুই বছর পর তাঁরা এ‌কে এ‌কে জেলখানা থে‌কে মু‌ক্তি লাভ ক‌রে। ভাষা সৈ‌নিক মমতাজ বেগমও ১৯৫৩ সা‌লের শেষ‌দি‌কে মু‌ক্তি পান। সে‌দিন রাষ্ট্রভাষা আন্দোল‌নে মমতাজ বেগম রাজপ‌থে পুরুষ‌দের যে সাহস যু‌গি‌য়ে‌ছি‌লেন, তা জাতীয় ক‌বি কাজী নজরুল ইসলা‌মের এক‌টি বাণী‌তে তাঁ‌কে খুঁ‌জে পাওয়া যায়- ‘‌কোন কা‌লে একা হয়‌নি‌কো জয়ী পুরুষের তরবারী ‌প্রেরণা দি‌য়াছে, শ‌ক্তি দিয়া‌ছে, ‌বিজয়ী লক্ষ্মী নারী।’

এই ভাষা সৈ‌নিক ১৯৬৭ সা‌লের ৩০ জুন ঢাকা মে‌ডি‌কে‌লে চি‌কিৎসাধীন অবস্থায় ই‌ন্তেকাল ক‌রেন। সরকার ২০১২ সা‌লে মমতাজ বেগম‌কে ম‌র‌ণোত্তর ‘একু‌শে পদক’-এ ভূ‌ষিত ক‌রেন। মর্গ্যান স্কু‌লের সামনের রাস্তা‌টি ‘ভাষা‌সৈ‌নিক মমতাজ বেগম সড়ক’ নামকরণ করা হ‌য়ে‌ছে।

লেখক : একজন সমাজকর্মী ও কলাম লেখক।

Islams Group
Islam's Group